অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী কি একজন সত্যিকারের আরবান নকশাল ছিলেন?

[বই থেকে উদ্ধৃত] ষাটের দশকের আর পাঁচটা বাঙালি তরুনের মতো তিনিও চরমপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন

 |  5-minute read |   25-09-2018
  • Total Shares

রশিদ কিদওয়াইয়ের নতুন বই থেকে নির্বাচিত অংশের বঙ্গানুবাদ। এই বইটিতে লেখক রাজনীতি ও সিনেমা জগৎ এবং এই দুই জগতের সম্পর্কের কথা লিখেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে শুরু করে হিন্দি সিনেমার বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় অভিনেতার জীবনকাহিনী ও তাঁদের জীবনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

body1_092518064541.jpgছবি সৌজন্যে: হ্যাচেট

অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী একজন সত্যিকারের আরবান নকশাল ছিলেন। বর্তমানে, এই শব্দবন্ধটি এক শ্রেণীর বামমনস্ক উদারপন্থীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের সমর্থকগণ এই আরবান নকশালদের উপস্থিতি দাবি করে বোঝাতে চাইছেন যে এরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ঠিক কতটা বিপজ্জনক।

১৯৫০ সালে ১৬ জুলাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গৌরাঙ্গ। পরবর্তীকালে যার নামকরণ হয় 'মিঠুন'। ষাটের দশকের আর পাঁচটা বাঙালি তরুনের মতোই মিঠুনও চরমপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এই ভাবধারার উপর ভিত্তি করেই কিন্তু বাংলায় নকশাল আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।

body2_092518064737.jpgমিঠুনের জীবনে দ্য নাকশালাইট সিনেমাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে [ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব]

এক দুর্ঘটনায় তাঁর ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং তাঁর মনে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গকে নকশাল মুক্ত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল পুলিশ। পুলিশের তাড়া খেয়ে মিঠুনকেও দীর্ঘ সময়ের জন্যে গা ঢাকা দিতে ফেরার হতে হয়েছিল।

পরবর্তীকালে, পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর মাথা থেকে তাঁর রাজনৈতিক অতীতের ভূত নামে।

সাংবাদিক আলি পিটার জনকে একবার মিঠুন বলেছিলেন কী ভাবে মুম্বাইতে (বম্বে) পা দেওয়ার আগেই তাঁর নাম সে শহরে পৌছিয়ে গিয়ে ছিল।

"কলকাতায় আমি যে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং নকশাল নেতা চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ ছিলাম তা সিনেমা জগতের ও জগতের বাইরে অনেকেই জানতেন। পরিবারে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমি এই আন্দোলন থেকে সরে আসি। কিন্তু নকশাল হিসেবে আমার পরিচয় কিন্তু পিছু ছাড়েনি। পুনের এফটিআইআই এমনকি সত্তরের দশকের শেষে মুম্বাই অবধি আমার এই পরিচয় আমাকে ধাওয়া করে বেরিয়েছে।"

body3_092518064920.jpgড্যান্সার ও ফাইটার হিসেবেই জনপ্রিয় ছিলেন মিঠুন [ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব]

খুব কম সময়ের জন্য হলেও বম্বেতে আসার পর সিনেমার পর্দায় আরও একটি নাম ব্যবহার করতেন মিঠুন - রানা রেজ।

বম্বেতে তাঁর সঙ্গে লেখক তথা চিত্র নির্মাতা খাওয়াজা আহমেদ আব্বাসের দেখা হয়। তিনি মিঠুনকে দ্য নকশালাইট (১৯৮০) সিনেমায় মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। তাঁর জীবনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি আবার ফিরে আসতে পারে এই ভয় মিঠুন শুরুতে এই সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি।

জনকে তিনি বলে ছিলেন, "কিন্তু আব্বাস সাহেবের নামটাই শেষ পর্যন্ত আমাকে এই চরিত্রে অভিনয় করতে উজ্জীবিত করে। ততদিনে, মানুষ আমাকে অভিনেতা থেকেও বেশি ড্যান্সার ও ফাইটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর, ঠিক এই সময়ে আব্বাস সাহেবের সিনেমায় একজন নকশালের ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরে আমি সত্যি ধন্য হয়েছিলাম।"

অভিনেতা মিঠুনের কাছে এই সিনেমাটি তাঁর অভিনয়ে জীবনের উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

পরবর্তীকালে এক সাখ্যাৎকারে মিঠুন বলেছিলেন, "এফটিটিআইতে আমি আব্বাস সাহেবের কথা শুনে ছিলাম। তার লেখা বেশ কয়েকটি অনবদ্য সিনেমা রাজ কাপুর তৈরি করে ছিলেন। আব্বাস সাহেব নিজেও কয়েকটি সিনেমা করে ছিলেন তা মুম্বাইতে সচরাচর যে সিনেমাগুলো তৈরি হয় তার থেকে অনেকটাই ভিন্নধর্মী। এমন একজন সাধারণ ও প্রতিভাবান লোকের সান্নিধ্য পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।"

আব্বাস শুরু থেকেই একটা বিষয় কঠোর ছিলেন। এই সিনেমার শুটিংয়ের সময়ে মিঠুন জাকজমক পোশাক পড়া বন্ধ করতে হবে, যে পোশাকগুলো তাঁর সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। তিনি আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন - শুটিংয়ের সময়ে কোনও মেক-আপ আর্টিস্ট বা হেয়ার-ড্রেসার রাখা হবে না আর যাতায়াতের জন্যে কোনও রকম হাতখরচ দেওয়া হবে না। আব্বাস চেয়েছিলেন শুটিংয়ের সময়ে মিঠুন কলকাতা থেকে বম্বে ট্রেনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে যাতায়াত করুক।

বক্স অফিসে খুব ভালো চলেনি 'দ্য নকশালাইটস', যদিও সিনেমাটির মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এর আগে ১৯৭৬ সালে তাঁর প্রথম ছবি মৃগয়াতে অভিনয়ের সুবাদে পাদপ্রদ্বীপের আলোতে চলে এসেছিলেন মিঠুন।

এর কয়েক দশক বাদে, রাজনৈতিক অভিষেকের সময় শশ্মানটা কিন্তু খুবই বেমানান।

বাংলার অন্যতম প্রিয় অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর সময়ে মিঠুন কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন। সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়া সময়তেই কেঁওড়াতলা মহাশশ্মানে দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিঠুনকে টিকিট দেওয়ার কথা বলেন। মিঠুন বলেছিলেন যে মমতা সেদিন তাঁকে বলেছিলেন, "আমি ভেবে নিয়েছি।"

মমতার তৃণমূলে যোগ দেওয়ার আগে মিঠুন বামেদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জ্যোতি বসুর জমানা শেষ হতেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন মিঠুন এবং, ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট সুভাষ চক্রবর্তীর মৃত্যর দিন তিনি মুম্বাই থেকে কলকাতা উড়ে আসেন। সেদিন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে তিনি সুভাষ চক্রবর্তীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান এবং এর পর তাঁর মরদেহ নিয়ে কেঁওড়াতলা মহাশশ্মান অবধি মিছিলে যোগ দেন।

body4_092518065009.jpgজ্যোতি বসু জমানার শেষে মিঠুনের সঙ্গে বামেদের সম্পর্কে ছেদ পড়ে [ছবি: রয়টার্স]

সুলতান আহমেদের মতো তৃণমূল নেতারা মনে করতেন যে সুভাষের সঙ্গে মিঠুনের এই ঘনিষ্ট সম্পর্কের জন্যে মমতার উচিৎ ছিল মিঠুনকে এড়িয়ে চলার। আসলে যতবারই মিঠুন কলকাতায় আসতেন ততবারই তিনি সুভাষের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে যোগ দিতে যেতেন। উল্টোদিকে, 'সুভাষ দাও' মিঠুনের হোটেলে বিনামূল্যে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন।

মিঠুন সুভাষ যুগলবন্দীর জন্যেই ১৯৮৬ সালে কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে 'হোপ ৮৬' অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্টানের মাধ্যমে বন্যা ত্রাণের তহবিলের জন্যে টাকা তোলা হয়েছিল। সিপিএমকে খুশি করতে মিঠুন অমিতাভ বচ্চন ও রেখাকে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন। তৎকালীন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সংস্কৃত মনষ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মিঠুনের অনুরোধে জ্যোতি বসুও (মিঠুন যাকে জ্যোতি কাকু বলে সম্বোধন করতেন) এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

যতবারই সিপিএম সরকার কোনও তহবিল তৈরির জন্যে অনুষ্ঠান করেন ততবারই মিঠুন একেবারে নিখরচায় এই অনুষ্ঠানগুলোতে পারফর্ম করেছেন। ২০০০ সালের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মিঠুনের সঙ্গে বাম সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে।

ভট্টাচার্য শুধুমাত্র মশালদার হিন্দি সিনেমা অপছন্দ করতেন তা নয়, সুভাষ চক্রবর্তীর প্রচুর সিদ্ধান্তও তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন।

কলকাতার ঐতহ্যশালী স্কটিশচার্চ কলেজে থেকে রসায়ন বিদ্যায় স্নাতক হয়েছিলেন মিঠুন। কলেজ জীবন কুস্তিগীর হিসেবেও বেশ নাম ডাক হয়েছিল তাঁর।

(হ্যাচেট বুক গ্রূপের অনুমতি নিয়ে বইয়ের নির্বাচিত অংশ বঙ্গানুবাদ করা হল)

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RASHEED KIDWAI RASHEED KIDWAI @rasheedkidwai ‏

Journalist-author Rasheed Kidwai is a visiting fellow of ORF]

Comment