উত্তরবঙ্গের এই পুজোয় মিলন ঘটে দুই বাংলার মানুষের

এই পুজোয় দরকার গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, মানসাই ও বানিয়াদহের জল

 |  4-minute read |   19-10-2018
  • Total Shares

উৎসবে কি কোনও সীমানা থাকে? নাকি কাঁটাতার উৎসবের আনন্দকে এপার ওপার দু’ভাগে ভাগ করতে পারে? পারে না। কারণ উৎসবের মূল কথা পারষ্পরিক আস্থা। আর তাই নিয়েই কোচবিহার জেলার দিনহাটার মহামায়াপাটের দুর্গা পুজোয় মিলে যায় এপার-ওপার দুই বাংলার মানুষ। একই আকাশ, একই ভাষায় কথা বলা মানুষ, তবু সারা বছর কাঁটাতারের বেড়ার জন্যই দু’পাড়ের মানুষ অবাধ মেলামেশা করতে পারে না। কিন্তু শারদোৎসবের কয়েকটা দিন তা যেন ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে মহামায়াপাটের পুজো প্রাঙ্গণ ফি বছর দুই বাংলার বাসিন্দাদের মিলন মঞ্চ হয়ে ওঠে।

দুবাংলার মিলনমঞ্চ

এখানে থিম নেই। নেই  মণ্ডপসজ্জার আতিশয্য। চোখধাঁধানো বাহারি আলোর কেরামতিও নেই। তবে পুজোর রং শরতের আলোর মতোই যেমন উজ্জ্বল, তেমনি উৎসবও ভরপুর আনন্দে মুখর। কাঁটাতারের বেড়া দুই বাংলার ভূখণ্ডকে দু’ভাগ করলেও মহামায়াপাটের দুর্গাপুজোর টান দু’পারের বাসিন্দাদের কাছে সমান। প্রতি বছরই পাসপোর্ট, ভিসা করে বাংলাদেশের বহু বাসিন্দা ওই পুজোয় সামিল হতে দিনহাটায় আসেন। আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে থেকে হাজির হয়ে যান মহামায়াপাটের দুর্গাপুজোর অঙ্গনে। বলা যায় এ যেন দুই বাংলার মানুষের মিলনমঞ্চের একটি ছোটখাট নিদর্শন।

tapan-puja-small_101918102233.jpgএই পুজোতেই মানত করেন দুই বাংলার ভক্তরা (ছবি: প্রতিবেদক)

পুজো উপলক্ষে চারদিন ধরে এখানে যে জমজমাট মেলা বসে সেটাও ওপার থেকে এপারে ছুটে আসার অন্যতম আকর্ষণ। তা ছাড়া মহামায়া যে তাঁদের ঘরের মেয়ে। তাঁকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে কাঁটাতার কি বাদ সাধতে পারে? 

লোকগল্প ও জনশ্রুতি

পুজো উদ্যোক্তাদের কথা মতো, দিনহাটার মহামায়াপাটের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল কোচবিহারের মহারাজাদের আমলে। স্থানীয় অনেক প্রবীণ অবশ্য এই মত মানতে নারাজ। তাঁদের ব্যক্তব্য, কোচবিহারের মহারাজাদের নিজেদের পুজো থাকতে তাঁরা নিজেদের রাজ্যে অন্য পুজোকে মেনে নেবেন কেন? আর তাঁদের পুজো বয়সে যেমন প্রাচীন তেমনই জাগ্রত।

মহামায়াপাটের দুর্গাপুজো ঘিরে নানা মতের পাশাপাশি পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লোকগাথাও। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৮৬ সালে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলে ডুয়ার্সের জয়ন্তী থেকে অধুনা বাংলাদেশের রংপুর পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। দিনহাটার কাছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে এক শ্রমিকের গাঁইতি পাথরে ওপর আঘাত করলে ঠং করে আওয়াজ হয়। সেই সঙ্গে ওই শ্রমিক জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান।

আশপাশ থেকে অন্য শ্রমিকরা ছুটে আসেন। আচমকা ওই ঘটনায় তাঁরা খুব অবাক হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর ওই শ্রমিক জানান, পাথর আর লোহার ঘর্ষণে সৃষ্টি হওয়া বিদ্যুতের চমকে তিনি মাতৃরূপ দর্শন করেছেন। এরপর ওই পাথরের খণ্ডকেই দেবীরূপে নিত্যপুজো শুরু।

পুজো শুরু হওয়ায় মন্দির নির্মাণের তোড়জোড় পড়ে যায়। ইতিমধ্যে ওই শ্রমিকটিকে দেবী স্বপ্নাদেশে জানান, তাঁকে দুর্গা রূপে পুজো করতে হবে। তারপর থেকে সারা বছর ওই পাথরখণ্ডকেই যেমন মহামায়ারূপে পুজো চলছে, পাশাপাশি প্রতিপদের দিন থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গা হিসেবে পুজো করার রীতি প্রচলিত আছে।

প্রচলিত গল্পেও রকমফের আছে। রেললাইন পাতার জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকরা গোলাকার  একটি পাথরের খণ্ড দেখতে পান। ওই পাথটি পেঁচিয়ে ফণা তুলে ছিল একটি সাপ। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই পাথর খণ্ডটিকেই দেবী মহামায়া রূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়। শ্রমিকরা শরৎকালে ফের দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহামায়াকেই দেবী দুর্গা রূপে পুজোর আয়োজন করেন। প্রতিমার বিশাল আকার ও পুজোর প্রাচীনত্বের জন্য ওই পুজো বাসিন্দাদের একাংশের কাছে ক্রমে ‘বড়মা’র পুজো নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বাহার নয় নিয়ম নিষ্ঠা 

আয়োজন নয়, নিষ্ঠাই বড়মার পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মণ্ডপ তৈরিতে কোনও বাড়বাড়ন্ত নেই ঠিকই, কিন্তু প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন তালপাতার পুঁথির উপরে হাতে লেখা নির্দেশ ও মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজো হয়।

রীতি মেনে সন্ধিপুজোয় জ্বালানো হয় ১০৮টি প্রদীপ। উপকরণ তালিকায় থাকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, মানসাই, বানিয়াদহ নদীর জল। চণ্ডীপাঠ ও হোমযজ্ঞ হয়। মনের ইচ্ছে পূরণের প্রার্থনা নিয়েও অনেকে ভিড় করেন। চলে মানতের হিড়িক।

মহামায়াপাট চত্বরে আয়োজিত নিয়ম-নিষ্ঠার বড়মার পুজোর সঙ্গে দিনহাটার বাসিন্দাদের বাড়তি আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। দেবীর উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দেওয়া থেকে ভোগ নেওয়া -- সবেতেই ভিড় উপচে পড়ে।

india-bangaldesh-reu_101918102402.jpgকাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকানো যায় না আবেগ (উপস্থাপনামূলক চিত্র, রয়টার্স)

পুজো উদ্যোক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, পঞ্জিকার বিধান মেনে বড়মার পুজো হয়। বাসিন্দারা অঞ্জলি কিংবা দেবীর উদ্দেশে ভোগ, সন্দেশ দিতে এই পুজোকেই এক নম্বরে রাখেন। শুধু মহাষ্টমীতেই প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার সন্দেশের প্যাকেট জমা হয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় অসম ও ওপার বাংলার বাসিন্দাদের উপস্থিতি।

অন্তরে নেই ভাগাভাগি

এই পুজোয় চাঁদা তোলার কোনও রেওয়াজ শুরু থেকেই ছিল না, এখনও নেই বললেই চলে। প্রতিমা প্রসাদ থেকে পুরোহিতের খরচও অনেকে ব্যাক্তিগত ভাবে বহন করেন। স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেরাই আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। আড়ম্বর যে নেই সেটাই যেন বিশেষত্ব, ঐতিহ্যও বলা যায়। এমন একটা পুজো খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে পুজোর আর্থিক অবস্থা থাকা স্বত্বেও মণ্ডপ কিংবা অন্যান্য জাঁকজমককে অনাবশ্যক মনে করেন উদ্যোক্তারা, অথচ সেই পুজোতেই মানুষের ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।

রাষ্ট্রসীমানা-কাঁটাতার মানচিত্র ভাগ করতে পারে। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে তাকে মান্যতা দেওয়াই নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু বিশ্বাস বা হৃদয়ের আবেগে সেই নীতি কার্যকরী হয় না শেষপর্যন্ত। তাই ওপার বাংলার মানুষের এখানে স্বাগত। তাঁরাও এই পুজোকে নিজেদের পুজো মনে করে ছুটে আসেন, মানত করেন, মনস্কামনা পূরণ হলে বিশ্বাস বেড়ে যায়।

আসলে কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার মহামায়াপাটের বড়মা-র পুজো জোর দিয়ে এ কথাই জানিয়ে দেয়, দেশ ভাগ হলেও ভাগ হয়নি হৃদয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TAPAN MALLICK CHOWDHURY TAPAN MALLICK CHOWDHURY

The writer is a journalist.

Comment