তৃতীয় লিঙ্গ কী? সে বিষয় সচেতনতা শুরু হোক স্কুলস্তরেই

সব সময় শুধু সদিচ্ছা থাকলেই চলে না সঙ্গে উদ্যোগও প্রয়োজন

 |  3-minute read |   08-09-2018
  • Total Shares

আমার দীর্ঘ ২৮ বছরের শিক্ষকতার জীবনে প্রায় প্রতি বছরেই স্কুলে কোনও না কোনও ছাত্র পেয়েছি যার মধ্যে পুরুষালী ভাবটা একটু কম এবং মহিলা সুলভ ভাবটা একটু বেশি। ছাত্র হিসেবে এরা প্রায় প্রত্যেকেই খুব মেধাবী ও পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ হলেও লক্ষ করেছি স্কুলে এটা যেন অন্যদের থেকে একটু ব্রাত্য। হাবভাবে জন্য অনেক সময় সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এমনকি বাড়ির আত্মীয়দের কাছেও বিদ্রুপের পাত্র হয় এরা। 

শিক্ষক হিসেবে আমিও বিভিন্ন সময় এদের নানারকম পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছি যাতে এরা নিজেদের হাবভাবে অন্যান্য ছেলেদের মতোই আচরণ করে। কিন্তু দেখলাম যে এদের মধ্যে একটা প্রবল আত্ম্যবিস্বাস আছে এবং এরা জানে যে এরা কোনও ভুল করছে না। তবে আমরা যেমন এদের কোনও রকম সাধুবাদও দিইনি তেমনই আবার তাদের চলার পথে কোনও রকম বাধার সৃষ্টিও করিনি। আমরা বরাবরই তাদের চিন্তাভাবনাকে সম্মান করেছি।

body1_090818085702.jpg

একদিন খবরের কাগজে দেখি আমাদের স্কুলেরই এক প্রাক্তনী নাম- শোভন মুখোপাধ্যায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য পাবলিক টয়লেট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি।

জানতে পারি যে শোভন তাঁর কাজের জন্য পুরস্কারও পেয়েছে। সেই পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ এবং তাঁদের বিভিন্ন সমস্যাকে প্রচারের আলোয় আনতে চায়। শোভন আমাকে বলে যে রূপান্তরকামী, সমকামী এবং এঁদের মতো যাঁরা আমাদের সমাজে প্রান্তিক হয়ে রয়েছে তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে। সে বলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই সচেতনতার প্রচার চালালে চলবে না। স্কুল স্তর থেকে সচেতনতার প্রচার আরম্ভ করতে হবে। রাস্তাঘাটে এবং বিভিন্ন জায়গায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের লোকে নানা নামে যেমন তাঁদের ডাকে তেমনই তাঁদের বিদ্রুপের সম্মুখীনও হতে হয়। তাই একদম স্কুল স্তরেই যদি এই সচেতনতা তৈরি করা যায় তাহলে শিশু মনে তার প্রভাব পড়বে অনেক বেশি এবং তাঁদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

body2_090818085718.jpg

তাই নেতাজিনগর বিদ্যামন্দির স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এই স্কুল থেকেই সচেতনতা সভা আরম্ভ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। আমি শোভনকে তাঁর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বলি এবং বলি আমরা তাঁর পাশে আছি।

এরপর আমি যখন স্কুলের উপর মহলের কাছে এই প্রস্তাব রাখি তখন আপত্তি না করলেও তাঁরা প্রথমটায় বিষয়টা নিয়ে একটু সন্দিহান ছিলেন। যাতে মূল অনুষ্ঠানের দিন কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তাই ওয়ার্কশপের আগে আমরা সব শিক্ষকরা মিলে ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। তাতে কাজও হয়।

দু'ঘণ্টার এই ওয়ার্কশপে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সব পড়ুয়ারা অংশগ্রহণ করে।   

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই ওয়ার্কশপের খবর ছড়িয়ে পড়ে। আমার বহু বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনেরা এবং অন্যান্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান। তারপর আমি যখন তাঁদের নিজেদের স্কুলেও এইধরণের সচেতনতা মূলক সভা করার পরামর্শ দিই তখন তাঁরা ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে চলে যান। তবে আমি বলছি না যে অন্যান্য স্কুলগুলি এই ধরণের সচেতনতা সভা করবেন না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে এটা ভেবে ভালো লাগছে যে আমাদের স্কুল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কথা এবং তাঁদের অসুবিধার দিকটা নিয়ে ভেবেছে এবং কিছু করার চেষ্টাও করেছে। সব সময় শুধু সদিচ্ছা থাকলেই চলে না সঙ্গে উদ্যোগও নিতে হয়।

body3_090818085729.jpg

আর একটা বিষয় ভেবে আজ আমার খুব ভালো লাগছে সেটা হল আমরা এই ওয়ার্কশপটি করার কয়েকদিনের মধ্যেই সুপ্রিমকোর্ট ৩৭৭ ধারা নিয়ে এই যুগান্তকারী রায়টি দিল। ব্যাপারটা যদিও পুরোপুরি কাকতালীয় কিন্তু তবুও ভাবলে খুব গর্ব বোধ হচ্ছে। 

বিশ্বাস করবেন না, এই ওয়ার্কশপের পরে আমি স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছি। একটা মজার ব্যাপার হল তারা এখন নিজেদের সম্বন্ধে একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করছে বললেও ভুল বলা হবে না। তারা এখন জানে যে এই বিষয় তারা যতখানি বোঝে অনেক শিক্ষিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তা বোঝেন না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

AVIJIT BANERJEE AVIJIT BANERJEE

Teacher-In-Charge

Comment