অপছন্দের সংবাদের কোপ সাংবাদিকের উপর, ক্ষমতা ছাড়াই ঔদ্ধত্য বিজেপির
সোজা হোয়াইট হাউস থেকে ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেন
- Total Shares
ক্ষমতা মানুষকে দুর্বিনীত করে, ক্ষমতা মানুষকে উদ্ধত করে। সাধারণ ভাবে মানুষ এই সত্যটা মেনে এসেছে। এই সত্যটা মেনেই অনেক অনৈতিক কাজের সঙ্গে আপোস করে মানুষ -- রাজনীতির ময়দানে যাঁরা জনগণ হিসাবে পরিচিত।
আবার যে কোনও গণতন্ত্রে নানা রকমের নেতিবাচক দিক থাকলেও একটি ছোট্ট ইতিবাচক দিক হচ্ছে যে এই জনগণের মধ্য থেকেই কোথাও না কোথাও আয়না দেখানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সেটাই গণতন্ত্রকে মজবুত করে।
সংবাদ মাধ্যমের শুরুর সময় থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও কোথাও না কোথাও এই সংবাদমাধ্যমই আয়না দেখানোর কাজটি সাধারণ ভাবে করে থাকে। সেই কারণেই সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের তকমা দেওয়া আছে। ঠিক একই কারণে প্রতিবর্ত ক্রিয়া হিসাবে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের মরিয়া চেষ্টা থাকে।
একনায়কতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক বা অন্য যে কোনও ব্যবস্থায় এটাই সত্য হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু এই যাবতীয় অপবাদ বা সংঘাত একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রকট হয় সাধারণত যখন সেই দল ক্ষমতায় থাকে। ইদানীং কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সে দেশের এক পৃথিবীখ্যাত সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকের সংঘাত প্রচণ্ড ভাবে আলোচনার মধ্যে রয়েছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে বারে বারে সংঘাত সৃষ্টি করেছেন ট্রাম্প (ছবি: রয়টার্স)
কিন্তু আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়, সোজা হোয়াইট হাউস থেকে ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেন, কলকাতা।
ইদানীং কালে ভারতেও শাসক বনাম সংবাদমাধ্যমের একটা সংঘাতের বিতর্ক চরমে উঠেছে। সেটা রাজধানী দিল্লি থেকে বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যে। বাস্তবে লড়াইটা এখন আর সংবাদমাধ্যম বনাম শাসকদল নয়, শাসকদল বনাম সংবাদকর্মী – এই পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে।
মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজ্য ছাড়া কেন্দ্রীয় স্তরে দিল্লি এবং আলাদা আলাদা ভাবে প্রায় বহু রাজ্যেই সংবাদকর্মীরা কোণঠাসা। এ ক্ষেত্রে শাসকের চরিত্রটা দলমত নির্বিশেষ একেবারে একরকম। অভিযোগ আছে যেমন দিল্লিতে তেমনই আছে পশ্চিমবঙ্গে অথবা তামিলনাড়ুতে অথবা গুজরাটে। কেউ কেউ বলেন পঞ্জাবেও।
কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংবাদকর্মীদের অভিযোগ শাসকদলের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যেটা বিস্মিত করেছে সংবাদকর্মীদের। এটাই যদি এখনকার মনঃস্তত্ত্ব হয়ে থাকে তা হলে আগামী দিনে তা কী ধরনের বিকৃত এবং ধ্বংসাত্মক চেহারা নিতে পারে।
ঘটনাটি অত্যন্ত ছোট্ট এবং হয়তো বা অকিঞ্চিৎকরও। কিন্তু ঘটনাটি একটি । মানসিকতার পরিচায়ক। কলকাতার একটি প্রথমসারির দৈনিক সংবাদপত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির অপছন্দের একটি খবর প্রকাশিত হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র বা সাংবাদিককে প্রতিবাদপত্র পাঠানোটাই রেওয়াজ। আরও এক কদম এগলে আদালতে মামলা হতে পারে। এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বীকৃত ব্যবস্থা।
এর বাইরে যদি কোনও ভাবে সেই সাংবাদিককে ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হয় বা তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা হয় তা হলে সেটাকে ঔদ্ধত্য বা আগ্রাসী মানসিকতা হিসাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
ইদানীংকালের সংবাদজগৎ বহুলাংশে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর, অর্থাৎ হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার এবং ফেসবুক।
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের খবর আদানপ্রদানের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহৃত হয়। এটা প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার – এর মধ্যে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, কোনও আইনি বাঁধুনি নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীর এই ধরনের গ্রুপে থাকাটা জরুরি তাঁর কাজের প্রয়োজনে। সম্প্রতি সেই সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের সংবাদকর্মীটিকে রাজ্য বিজেপির এই রকমই একটি গ্রুপ থেকে উৎখাত করা হয়েছে কোনও কারণ না দেখিয়ে।
সাাম্প্রতিক অতীতে জ্যোতি বসুই প্রথম সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণে মুখর হন (ফাইল চিত্র/ পিটিআই)
ঘটনাটি অতি সামান্য এবং এই গ্রুপের সদস্য না হলে কোনও সংবাদকর্মীর চাকরিও বিপন্ন হয় না অথবা তাঁর সংবাদ সংগ্রহের যদি সত্যিই দক্ষতা থাকে তা হলে তিনি পিছিয়েও পড়বেন না। কিন্তু একটা অপছন্দের খবরের জন্য একজন সংবাদকর্মীকে গ্রুপ থেকে উৎখাত করা একেবারেই স্বৈরাচারী মানসিকতার পরিচয়। রাজ্য বিজেপি এখও ক্ষমতা থেকে শত যোজন দূরে। আগামী দিতে রাজনীতি কী চেহারা নেবে সেটাও অনিশ্চিত।
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদকর্মীরা আধুনিক যুগে নতুন করে জ্যোতি বসুর আমল থেকে আক্রান্ত হতে অভ্যস্ত। কিন্তু সেটা শাসকদলের পক্ষ থেকে। সাম্প্রতিক কালে জ্যোতি বসু প্রথম কলকাতার রানি রাসমণি রোডে সিপিএমের যুবসংগঠনের একটি সভা থেকে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিত করেছিলেন। তারপর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তারপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – সংবাদকর্মীরা নিজেদের মতো করে নিজেদের বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন।
কিন্তু একটা রাজনৈতিক দল, পশ্চিমবঙ্গে যার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত, তাদের শিশু অবস্থাতেই এই ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সংবাদকর্মীদের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।