মৌসম বেনজির নূর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় মালদহে কী প্রভাব পড়বে?
মালদহে ভোটের মেরুকরণ শুরু হয়েছে, হাত চিহ্ন ও গণি খানও ফ্যাক্টর
- Total Shares
নবান্নে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন মৌসম বেনজির নূর, যাঁর নামে এখনও মালদহে ভোট হয় সেই প্রয়াত এবিএ গনি খান চৌধুরীর ভাগ্নি এবং মালদহ উত্তর কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ। রাজ্যজুড়ে যখন তৃণমূলের হাওয়া, তখনও কংগ্রেসের সমর্থকের জোরেই হোক বা গনি খান চৌধুরীর নামের জোরে, মালদহে দু’টি লোকসভা কেন্দ্র থেকেই জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীরা।
গনি খান চৌধুরীর নামের জোরে পরিবারের লোকেরা এখনও জেতেন, নাকি কংগ্রেসের চিহ্নের জেরে, এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এই মুহূর্তে মুশকিল হলেও, গনি খান চৌধুরীর পরিবারের মধ্যে লড়াই হলে কংগ্রেসই এগিয়ে থাকবে। ২০১৬ সালে গনি খানের ভাই আবু নাসের খান চৌধুরী (লেবু) ও ইশা খান চৌধুরীর মধ্যে মুখোমুখি লড়াই হয় সুজাপুর কেন্দ্রে। গনি খানের আরেক ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরীর (ডালু) ছেলে ইশা। কংগ্রেস প্রার্থী ইশা পান ৫৮.৪৬ শতাংশ ভোট এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী নাসের পান ৩০.১৪ শতাংশ ভোট।
তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন মৌসম নূর। (নিজস্ব চিত্র)
২০১৬ সালে কংগ্রেস ও সিপিএম জোট করে লড়াই করেছিল।
২০১৯ সালের ভোটে এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস-সিপিএম জোটের কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আসন্ন লোকসভা ভোটে মালদহে কী হবে তার আন্দাজ করা যেতে পারে পূর্ববর্তী ভোটের ফল ও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফল এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বেশ কয়েকটি জায়গায় বিজেপির ভোট বেড়েছে।
এ রাজ্যে ২০১৪ সালে মোদী-ঝড়ের সময় বিজেপি যে প্রভাব পাররেনি, সাম্প্রতিক অতীতের বেশ কয়েকটি ঘটনায় রাজ্যে তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পেরেছে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভোটের মেরুকরণ শুরু হয়েছে যার সুবিধা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে বিজেপি, মালদহও ব্যতিক্রমী থাকছে না।
মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ১৯.৫২ শতাংশ ভোট, যেখানে ২০১৪ সালে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৮.৯৮ শতাংশ। এই ব্লকে মুসলমান জনসংখ্যা ৫৭.১৮ শতাংশ। দু’বছরের মধ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। তাই ভোটের মেরকরণ ঘটলে এখানে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে বিজেপির। হরিশ্চন্দ্রপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। হবিবপুরে এতটা না বাড়লেও ২ শতাংশ মতো বেড়ে ২০১৬ সালে ২২.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি।
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের তুলনায় ভোট ৮.৭১ শতাংশ বেড়ে ২০১৪ সালে মালদহ উত্তর কেন্দ্রে বিজেপির ভোট ১৫.৩৯ শতাংশ হয়েছিল।
মালদহ উত্তর লোকসভার অন্তর্গত বিধানসভা আসনগুলিতে বিজেপির ভোট ক্রমেই বাড়ছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতির মতো বড় মাপের নেতারা ভোটের আগে জনসভা করলে তাতে বিজেপির ভোট বাড়ার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হবে। এই কেন্দ্রে বিজেপি কত নম্বরে থেকে শেষ করবে, তার জন্য বেশ কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে সবার আগে যে দু’টি ব্যাপার বিবেচনা করতে হবে তা হল ভোটের মেরুকরণ ও ভোট ভাগাভাগি।
ভোটের মেরুকরণ মানে বিজেপি কতটা হিন্দু ভোট টানতে পারে। আর ভোট বিভাজন মানে সেখানেও দু’টি ব্যাপার কাজ করবে। কংগ্রেস, তৃণমূল ও সিপিএম কতটা মুসলমান ভোট কাটাকাটি করতে পারে এবং কংগ্রেস ও তৃণমূল প্রার্থীর দু’জনেই গনি খানের পরিবারের হলে কে কত ভোট টানবে। এ ছাড়া আরও একটি ব্যাপার থেকে যাবে। পাঁচ বছরে সাংসদ হিসাবে মৌসম বেনজির নূর কতটা ভোট টানতে পারেন। মালদহ উত্তর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হতে চলেছেন বর্তমান কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর এবং তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের হয়ে লড়তে চলেছেন তাঁরই পরিবারে ইশা, যিনি বর্তমানে সুজাপুরের কংগ্রেস বিধায়ক। সুজাপুর কেন্দ্রটি মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
নিজের কেন্দ্রে মৌসম নূর। (ফাইল চিত্র: পিটিআই)
২০১৪ সালে এই কেন্দ্রে জয়ী মৌসম বেনজির নূরের (৩৩.৪১ শতাংশ) সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের খগেন মুর্মুর (২৭.৪৬) ভোটের ব্যবধান ছিল ৬৫,৭০৫। তখন বিজেপি (১৫.৩৯ শতাংশ) ও তৃণমূল (১৬.৯৬ শতাংশ) অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। যদি কংগ্রেস ও তৃমমূল উভয়েই গনি-পরিবারের সদস্য হন তা হলে প্রাপ্ত ভোটে অনেকটাই রদবদল ঘটবে।
চুলচেরা বিশ্লেষণ করা এবং ভোটাররা শেষ মুহূর্তে কাকে পছন্দ করলেন তার মধ্যে পার্থক্য থেকেই যায়। তা সত্ত্বেও একটা ব্যাপার অনেকটাই স্পষ্ট যে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম এবং বিজেপির মধ্যে লড়াই হলে মালদহ উত্তর কেন্দ্রে লাভ হবে বিজেপির।
মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ হলেন গনি খানের ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। এই কেন্দ্রেও যদি কোনও ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁর ভাই আবু নাসের খান চৌধুরীকে (লেবু) প্রার্থী করেন, তখনও এই কেন্দ্রের সমীকরণেও প্রভাব পড়বে মালদহ উত্তর কেন্দ্রের মতোই। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে বিজেপির ভোট এক লাফে সাড়ে ১৪ শতাংশ বেড়ে ১৯.৭৯ শতাংশ হয়েছিল।
২০২১ সালে বিধানসভা ভোট। তাই ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মালদহে যদি চারমুখী লড়াই হয়, তা হলে একাধিক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে। তখন পরবর্তী নির্বাচনের আগে কী সমীকরণ হবে, তাও নির্ভর করবে ২০১৯ সালের ভোটের ফলের উপরে।