এ রাজ্যে কী ভাবে বিজেপির ভোট ভাঙাচ্ছেন মমতা?
আদিবাসী-নমঃশূদ্র-অবাঙালি: সকলের জন্য আলাদা ভাবনা মমতার
- Total Shares
পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির উত্থানের পরেই রাজনৈতিক ভাবে বিজেপির মোকাবিলা শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক এক করে পদক্ষেপ করে তিনি বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ককে নিজের দিকে আনার চেষ্টা করছেন।
রাজ্যের মুসলমান ভোটাররা এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র মুসলমান ভোট দিয়ে বিজেপিকে যে পুরোপুরি আটকানো সম্ভব নয় সে কথা পঞ্চায়েত ভোটেই বুঝেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যে ভাবে এ রাজ্যে ভোটের মেরুকরণ হচ্ছে তাতে শাসকদলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিজেপিই। তারা এখন আর প্রাপ্ত ভোটের বিচারে দু’নম্বর থাকতে চাইছে না। এখন তারা আসন চাইছে। বিজেপির ভোট বাড়ছে ঠিকই, যাতে আসন না বাড়ে সেটিই নিশ্চিত করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আদিবাসীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ফাইল ছবি: পিটিআই)
দীর্ঘদিন ধরেই এ রাজ্যে বিজেপির মূল ভোটব্যাঙ্ক হল অবাঙালি হিন্দুরা। এখনও বিজেপি যে বাঙালির দল হয়ে উঠতে পারেনি সে কথা দলের নেতারাও একান্তে স্বীকার করে নেন। তবে অবাঙালি হিন্দু ভোটের পাশাপাশি বর্ণহিন্দু ভোট ও আদিবাসী ভোটও বিজেপির দিকে পড়তে শুরু করে, বাড়তে থাকে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। ধর্মীয় মেরুকরণের সুবিধাও পেতে শুরু করে বিজেপি।
লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মুকুল রায়ের দ্বন্দ্ব যখন বেশ কিছুটা প্রকাশ্যেই তখন তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তৃণমূলে কারও নেই।
আদিবাসী ভোট
পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহলে ভালো ফল করেছিল বিজেপি। পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামে তাদের ফল একটি প্রশ্ন তুলে দেয়, তা হলে কি জঙ্গলমহল তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করছে? তাঁকে ভুল না বোঝার জন্য আবেদন করেন মুখ্যমন্ত্রী। ভোটের পরে অস্বাভাবিক ভাবে দুই বিজেপি কর্মীর মৃত্যুও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে রাজ্যের গণতন্ত্র নিয়ে। তবে তার পরেও জঙ্গলমহল যে বঞ্চিতই সেই খবর প্রকাশিত হতেই আলোড়ন পড়ে যায় রাজ্যের প্রশাসনে।
রাজ্যের লালগড়ে কয়েক সপ্তাহ আগে সাত জন শবরের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন ওঠে আদিবাসীরা কেমন আছেন। একদিন এই জঙ্গলমহল মোটামুটি মাওবাদীদের দখলেই চলে গিয়েছিল। এখনও জঙ্গলমহল থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহারের পক্ষে নন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যদিও বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘জঙ্গলমহল হাসছে’।
পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি ভালো ফল করার পরে অনগ্রসর শ্রেণী বিষয়ক মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাত ও আদিবাসী কল্যাণমন্ত্রী জেমস কুজুরকে সরিয়ে দুই দপ্তরই নিজের হাতে নেন মুখ্যমন্ত্রী। সরিয়ে দেন মহকুমাশাসক, বিডিও এবং পুলিশের আইসি-দের। দলীয় সংগঠনেও পরিবর্তন করেন। ঝাড়গ্রামে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
Homage to the great freedom fighter Birsa Munda on his birth anniversaryস্বাধীনতা সংগ্রামী বিরসা মুন্ডার জন্মদিবসে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 15, 2018
পরে উত্তরবঙ্গ সফরের সময়ে ডুয়ার্সের টিয়াবাড়িতে আদিবাসীদের জমি বিজেপিকে নিতে দেবেন না বলে মমতা হুঁশিয়ারি দেন। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন করেই এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি ও প্রশস্ত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জমি যাওয়ার আতঙ্ক সেই সময়ে কৃষকদের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। ডানকান চা বাগান নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি রাখেনি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিজেপির কথায় যাতে তাঁকে আদিবাসী ভুল না বোঝেন সেই আবেদনও করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে এখন আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, আদিবাসীদের সত্যিই কতটা উন্নতি হয়েছে এ রাজ্যে।
নমঃশূদ্র ভোট
দেশ ভাগের পরে এ রাজ্যে নমঃশূদ্ররা বঞ্চিতই বলা চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম ঠাকুরনগরে গিয়ে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছিলেন। তখনও রাজ্যে শাসকদল বামফ্রন্ট। বামফ্রন্টের এক মন্ত্রীও দৌত্য করেছিলেন ঠাকুরনগরে মতুয়াদের প্রধান ‘বড়মা’ বীণাপানি দেবীর কাছে। তবে মতুয়া ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্য ভোটে প্রার্থী হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে।
সম্প্রতি নমঃশূদ্রদের উন্নয়নের জন্য বোর্ড তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণের জন্য শতায়ু বীণাপানি দেবীকেই বেছে নিয়েছেন। এটা মতুয়া তথা নমঃশূদ্রদের মন জয় করার জন্য তাঁর মাস্টারস্ট্রোক।
দেশভাগের পরে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে যে সব হিন্দু এ দেশে এসেছেন তাঁদের কথা ভেবে বিজেপি সরকার বিল আনছে। এ রাজ্যেও নাগরিক পঞ্জীকরণ হবে বলে বারে বারে ঘোষণা করেছেন বিজেপির নেতারা। এর ফলে সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ হওয়ার দিকে যাচ্ছিল, বিশেষ করে যে সব জায়গায় সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরপর কয়েকটি পদক্ষেপ বিজেপি সেই আশায় জল ঢালছে।
Today, at the invitation of All India Matua Mahasangha, I was present in the birth centenary celebration Boro Ma, Binapani Thakur at Thakurnagar, North 24 Parganas. My #Facebook Post >> https://t.co/plBk7oJzXB pic.twitter.com/sVBfrcVDcY
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 15, 2018
হিন্দু ভোট মেরুকরণ রোধ
বিজয়াদশমীতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন করার জন্য যেখানে গত বছরও আদালতের অনুমতি নিতে হয়েছিল সেখানে এ বছর রাজ্যের ২৮,০০০ পুজোকমিটিকে ১০,০০০ টাকা করে ‘চাঁদা’ দিয়েছে সরকার। তাতে ছোট পুজোকমিটিগুলির সুবিধা হয়েছে।
রাজ্যে বিভিন্ন স্কুলে সরস্বতী পুজো বন্ধ হয়েছিল স্কুলে স্কুলে নবী উৎসব পালন করার দাবিতে, সেখানে পুলিশের লাঠিতে মাথা ফেটেছিল স্কুলছাত্রীর। তাতে হিন্দুরা তৃণমূলের থেকে সরে যাচ্ছিল। দুর্গাপুজোয় চাঁদা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ক্ষোভ অনেকটাই উপশম করতে পেরেছেন।
অবাঙালি হিন্দু ভোট
এ রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক বলতে বোঝাত অবাঙালি হিন্দুদের ভোট। সেই ভোট নিজের পালে টানতেও মুখ্যমন্ত্রী এ বারে বেশ সক্রিয়। তা দেখা গেছে বড়বাজারে জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে।
বড়বাজার মানেই অবাঙালি হিন্দুদের আধিক্য বেশি। তাই জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে গিয়ে আগাগোড়া হিন্দিতেই বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই তিনি অভিযোগ করেন, বিজেপির জমানায় অনেক গর্বের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেখানে তিনি নরেন্দ্র মোদীর জমানায় দুর্নীতিদমন শাখা-সিবিআই-আয়কর দপ্তরের প্রসঙ্গ তোলেন, বাদ দেনেনি নেটবন্দি প্রসঙ্গও।বড়বাজার মানেই অবঙালি হিন্দু ব্যবসায়ী। তাই তিনি সেই সব প্রসঙ্গেই বলেন যা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মনে ক্ষোভ রয়েছে।
I was present in an inauguration ceremony of Jagadhatri Puja celebration at Kolkata today. May the festivities usher peace, prosperity, harmony and unity among all. Some pictures of today’s occasion are uploaded here for all of you. pic.twitter.com/95daNAtcGA
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 12, 2018
তার পরে ছটপুজোয় বাড়তি ছুটিও ঘোষণা করেছেন রাজ্যসরকারি কর্মীদের জন্য। মূলত যাঁরা বিহার থেকে এসে এ রাজ্যে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন, তাঁরাই ছটপুজো করে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের বাড়তি ছুটি দিয়ে তাঁদের মন জয় করতে চেয়েছেন।
On the auspicious occasion of #ChhathPuja, I visited some Ganga ghats of #Kolkata and extended my greetings to the devotees. May the celebration usher peace, prosperity, happiness and unity among all.Subho #ChhathPuja pic.twitter.com/xqfuMDOgAe
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 13, 2018
বকেয়া ডিএর বদলে ছুটি – রাজ্য সরকারি কর্মীদের প্রায়ই এ কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। তবে বিশেষ সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে মু্খ্যমন্ত্রী বাড়তি ছুটি ঘোষণা করায় তাঁরা যে খুশি হবেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দিল্লির রাজনীতির দিকেই মন দিচ্ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। বিজেপি-বিরোধী জোটও গড়া হচ্ছে তাঁকে সামনে রেখে। বেশ কিছুদিন তা থিতিয়ে যাওয়ায় ফেসবুক লাইভ করে নতুন ভাবে তাঁকে সামনে নিয়ে এসেছে তাঁর দল।
আগামী ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে যে সভা হবে সেই সভায় যে লোক উপচে পড়বে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে তার প্রতিচ্ছবি যাতে ইভিএমেও দেখা যায় এখন সেই কাজেই মন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে।