অবৈধ খাদান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি ও বাস্তব অবস্থা
রাজস্বের ক্ষতিই নয়, অবৈধ খাদানে ভৌগোলিক অবস্থা ও আর্থসামাজিক প্রভাব মারাত্মক
- Total Shares
বালি ও পাথর খাদান নিয়ে সব ধরনের গণমাধ্যমে খবর হয়েছে, তার পরে স্থানীয় ভাবে নামকাওয়াস্তে পদক্ষেপও করে প্রশাসন। কিন্তু এ রাজ্যে কোনও দিনই বালি ও পাথরখাদান বন্ধে প্রকৃত অর্থে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি কোনওদিনই। লোকসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করছেন এবার সেই বৈঠকে অবৈধ খাদানের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। রাজ্যে অবৈধ বালি ও পাথরখাদান যদি সত্যিই বন্ধ করা যায় তা হলে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশা এখনও রয়েছে।
সরকার সত্যিই এই অবৈধ কাজকর্ম বন্ধ করতে পারলে প্রাথমিক ভাবে কিছুটা সমস্যা হতে পারে, তবে শল্য চিকিৎসা বা অপারেশনের যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে, না হলে তো রোগীর প্রাণটাই যাবে!
অবৈধ খাদান আটকাতে কড়া নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর (ইন্ডিয়া টুডে)
বালিখাদানে সমস্যা
বালিখাদান মানে নদীখাত। ছোটনাগপুর মালভূমির বিভিন্ন অংশ থেকে যে সব নদীর উৎপত্তি (যেমন দামোদর, সুবর্ণরেখা) সেই সব নদীতে শুধুমাত্র বর্ষাকালেই জল থাকে। বছরের অন্য সময়ে এই সব নদীতে জল থাকে না বললেই চলে। কোথাও কোথাও নদীর বুকে অল্পস্বল্প চাষাবাদও করতে দেখা যায়। এই ধরনের নদীগুলি হল বালির আকর।
তবে সমস্যা হল, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বালি তুলে ফেলা হলে পরিবেশের উপরে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে, পড়তে বাধ্য। শীত-গ্রীষ্মে জল না থাকলেও বর্ষায় এই সব নদীতে জল আসতে শুরু করে এবং প্রতিবেশী রাজ্যে বেশি বর্ষা হলে বাঁধ খুলে দেওয়ার ফলে প্রবল বেগে জল ঢুকে থাকে নদীতে। তখন যে সব অংশ থেকে বালি তুলে নেওয়া হয়েছে অবৈধ ভাবে, সেই সব অংশে জল ঢুকে ঘুর্ণী সৃষ্টি হয়, সেই কারণে চিরতরে নদী নাব্যতা হারায়।
এই ঘুর্ণীর ফলে জল এলোমেলো ভাবে ধাক্কা খায় পাড়ে, এ জন্য অস্বাভাবিক ভাবে পাড় ভাঙতে থাকে। নদীর স্বাভাবিক নিয়মে এক কূল ভাঙলে আরেক কুল গড়ে। কিন্তু অস্বাভাবিক ভাবে ভাঙলে তাতে কেবল ক্ষতির দিকটাই থাকে।
বালি খাদান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, এর ফলে হতে পারে ভৌগোলিক পরিবর্তনও (ডেইলিও বাংলা)
নদী পাড় ভাঙতে শুরু করতে তা আটকানো মুশকিল হয়। বাড়ি-ঘর-কৃষিজমি তলিয়ে যায়, তাই ভৌগোলিক সমস্যার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। সেতু ভাঙার প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়, কারণ সেতুর কাছাকাছি বালি তুললে সেতুর উপরে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
পাথরখাদানে সমস্যা
পাথরখাদানে সমস্যাও কম নয়। একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। জেলাপরিষদের রাস্তা তৈরির জন্য পুরুলিয়ায় জয়চণ্ডী পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মোরাম কাটা হয়। তাতে মোটামুটি নির্জন ওই এলাকায় এ নিয়ে কারও আপত্তি ছিল না, সরকারি রাস্তা তৈরির জন্য ঠিকাদার সংস্থা মোরাম কেটে সরকারি রাস্তার কাজেই তো ব্যবস্থা করছে, বাধা আসবেই বা কেন?
কিছুদিন পরে পর্বত-আরোহণে প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে কয়েকটি সংস্থা আসে আর এই অবস্থা দেখে তাঁরা একেবারে আঁতকে ওঠেন। বর্ষা নামলেই মোরাম ভিজবে, পাহাড়ের পাথরের চাপে তা সরে যাবে, কারণ আশপাশের অংশ কেটে নেওয়া হয়েছ, চাপ সহ্য করার কেউ নেই। তাতে লক্ষ লক্ষ কেন কোটি কোটি বছর স্থিতাবস্থায় থাকায় পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হবে, টন টন ওজনের পাথর গড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। বিপর্যয় হবে। ফেল আগের জায়গায় মোরাম ফেরানো শুরু হয়।
মুশকিল হল রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যে সব অবৈধ পাথর খাদান রয়েছে, সেই সব জায়গায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বৈধ খাদানে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয় বলে তা থেকে বিপর্যয়ের আশঙ্কা কম থাকে।
কয়লাখাদানে সমস্যা
এ রাজ্যে আসানসোল-বরাক উপত্যকা ঝুলন্ত, যে কোনও সময় বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে বারে বারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই সব অঞ্চলে পরিত্যক্ত খনিগুলিই মূলত মাফিয়াদের নজরে। সংসারে অভাব থাকায় এই সব এলাকায় খনিগুলির জন্য শ্রমিকের অভাব হয় না। কিন্তু খাদানে নেমে শ্রমিকের মৃত্যু এই সব অঞ্চলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
বেশ কয়েক বছর আগে এই অঞ্চলে সারাদিন ঘুরে লোকের সঙ্গে কথা বলার পরে, বাড়িতে বড় বড় ফাটল দেখে ও ছোট ছোট এলাকা গ্রস্ত উপত্যকার মতো বসে গেছে দেখে মনে হচ্ছিল যে এলাকার লোকজন সত্যিই প্রাণ হাতে করে বাস করছেন। কিন্তু তার পরেও খাদান বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি ও বাস্তব অবস্থা
এলাকায় ঘুরে কথা বললেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে রাজনৈতিক নেতাদের মদত না থাকলে এবং প্রশাসনের সঙ্ঘে যোগসাজস ছাড়া এ সব সম্ভব নয়। হয় প্রশাসন জেগে ঘুমাচ্ছে না হয় কোনও বিশেষ কারণে সব জেনেও চুপ থাকতে হচ্ছে। এই অবস্থায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্নীতিগ্রস্তদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশ্ন হল নির্দেশ কার্যকর করবে কে?
প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী (টুইটার)
স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক দাদাদের প্রবল প্রভাব রয়েছে। শহর কলকাতায় যেখানে শাসকদলের সমর্থকদের ভয়ে পুলিশকর্মীদের আশ্রয় নিতে হয় থানার ভিতরে টেবিলের নীচে, সেখানে গ্রামাঞ্চলে পুলিশকর্মীদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, অতএব বলির পাঁঠা জোগাড় করে হাঁড়িকাঠে চড়ানোর তোড়জোড় করা হবে। প্রভাবশালী দু’চারজনকে গ্রেফতারও করা হবে। তখন গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়বে।
চ্যানেলে বিতর্ক, পুলিশকে বাহবা, উন্নয়নের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঘুঘুর বাসা ভাঙার জন্য তাঁর নামে জয়ধ্বনি শোনা যাবে। যাদের পুলিশ গ্রেফতার করবে তাদের দিনকতক পুলিশ হেফাজত হবে, তারপরে জেল হেফাজত, তারপরে কী হবে সেই খবর কেউ রাখবে না।
সিসি ক্যামেরা বসানো হবে মাফিয়া ধরতে। শুধু একা দামোদরের কথাই ধরুন। এ রাজ্যে দামোদরের দৈর্ঘ্য ১৬০ কিমি। কতগুলো সিসি ক্যামেরা লাগবে! যদি ধরা হয়, এখন যেখানে খাদান আছে সেখানে নজরদারি করা হবে, তা হলে মাফিয়ারা অন্য জায়গা বেছে নেবে।
যদি গ্রামপঞ্চায়েত-পুরসভার জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে সচেষ্ট হন, পুলিশের সদিচ্ছা থাকে এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা তৎপর থাকেন তা হলে অবৈধ খাদান আটকানো সম্ভব। কিন্তু এঁরা কতটা একযোগে উদ্যোগী হবেন তা লাখ টাকার প্রশ্ন।
টোলট্যাক্স বাঁচাতে বড় বড় লরিগুলিকে জরিমানা করার পাশাপাশি আটকে রাখার কৌশলের কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যখন প্রশ্ন করেছেন তখন শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের মতো সমস্বরে সম্মতি জানিয়েছেন আধিকারিকরা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁরা কতটা কী করেন তা কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।