মধ্যপ্রদেশে বিজেপি হেরেছে নাকি কংগ্রেস জিতেছে

বহু কেন্দ্রেই জয়পরাজয়ের ব্যবধানের চেয়ে নোটায় ভোট পড়েছে বেশি

 |  4-minute read |   13-12-2018
  • Total Shares

ইভিএমের যুগেও মধ্যরাত পর্যন্ত ভোট গোনা চলল মধ্যপ্রদেশে। মধ্যপ্রদেশে কেন বিজেপি হারল তা খতিয়ে দেখার আগে দেখে নেওয়া যাক, কেন রাত পর্যন্ত ভোট গণনা চলেছে।

প্রায় পৌনে এক ডজন কেন্দ্রে বিজেপিকে হারতে হয়েছে নোটার জন্য, মানে এই সব কেন্দ্রে কোনও প্রার্থীই পছন্দ ছিল না ভোটদাতাদের। ইন্ডিয়া টুডের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্তত নটি কেন্দ্রে জয়-পরাজয়ের ব্যবদানের চেয়ে নোটায় পড়া ভোট বেশি ছিল। যেমন সুওয়ারসায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৩৫০ ভোটে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী, নোটায় পড়েছে ২,৯৭৬ ভোট। জবলপুর উত্তরে জয়-পরাজয়ের মধ্যে ব্যবধান ছিল ৫৭৮টি ভোট, নোটায় পড়েছে ১২০৯টি ভোট। দামো কেন্দ্রে নোটায় পড়েছে ১২৯৯টি ভোট, ব্যবধান ৭৯৮। বিয়াওরায় নোটায় পড়েছে ১৪৮১টি ভোট আর জয়ের ব্যবধান ৮২৬।

মোট ১৪টি করে ইভিএম নিয়ে একটি করে রাউন্ড হয়। প্রতিটি ইভিএমে ১০০০টি পর্যন্ত ভোট থাকতে পারে। লটারির মতো করে বেশ কয়েকটি যন্ত্র বেছে ভিভিপ্যাড থেকে প্রিন্ট করে দেখে নেওয়া হয় সব যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করেছে কিনা। তারপরে ১৪টি ইভিএম থেকে প্রিন্ট নিয়ে কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন তা কাগজে-কলমে (ম্যানুয়ালি) যোগ করা হয়। সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে পরের রাউন্ডে যাওয়া হয়। যেখানে দুই যুযুধান পক্ষের ভোটের পার্থক্য খুব কম থাকে তখন একাধিক বার গোনা হয়। যে প্রার্থী সামান্য ভোটে পিছিয়ে পড়ছেন তিনি পুনরায় গণনার দাবি করেন এবং সাধারণত সেই দাবি মেনে আবার গোনা হয়। তাতেই বিলম্বিত হয় ভোট গণনা প্রক্রিয়া। এই কারণেই মধ্যপ্রদেশে ভোট গণনায় অস্বাভাবিক দেরি হয়েছে।

shivraj_singh_121318091705.jpegজনপ্রিয়তায় এখনও তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই, তবুও শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারলেন না (ইন্ডিয়া টুডে)

সেদিন যাঁরা টিভির পর্দায় চোখ রেখেছিলেন তাঁরা দেখেছিলেন যে একবার বিজেপি এগিয়ে যাচ্ছে, একবার কংগ্রেস। অর্থাৎ সামান্য ভোটে একপক্ষ এগিয়ে গেলে অপর পক্ষ পুনর্গণনা দাবি করছেন।

এ বার আসা যাক আসল কথায়, কেন মধ্যপ্রদেশে হারতে হল বিজেপিকে।

এ ক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হবে, সাম্প্রতিক কালে বড় রাজ্যগুলিতে (যেখানে ২০০-র বেশি বিধানসভা আসন) ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের আসনসংখ্যার পার্থক্য মাত্র ৫ (পাঁচ)। পনেরো বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া ও কৃষক অসন্তোষের পরেও সেই সুযোগ কি কংগ্রেস সে ভাবে কাজে লাগাতে পারল না?

মধ্যপ্রদেশে গত ১৫ বছরে উন্নয়ন হয়নি, এ কথা কংগ্রেসও বলছে না বা বলতে পারেনি। তবে মন্দসৌরে কৃষকবিক্ষোভ প্রমাণ করে রাজ্যের কৃষকরা সরকারের উপরে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তা সত্ত্বেও সুওয়ারসা বিধানসভা কেন্দ্রে কেন এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে? সুওয়ারসা বিধানসভা কেন্দ্রটি মন্দসৌর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, যেখানে পুলিশের গুলিতে ৬ কৃষকের মৃত্যু হয়েছিল।

গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের সদস্য (রাজতন্ত্র থাকলে যিনি রাজা হতেন) জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে অনেকে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন। সেই দক্ষিণ গোয়ালিয়রে কংগ্রেসপ্রার্থী জিতেছেন মাত্র ১২১ ভোটে।

ব্যাপম নিয়ে শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, তোলপাড় হয়েছে পুরো দেশ। তার সুবিধাই বা নিতে পারল কই কংগ্রেস? এ রাজ্যে বিজেপিকে প্রথম থেকে তেমন প্রচারে দেখা যায়নি, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহ্বান একাই প্রচার করে গেছেন। শেষ দিকে তাঁর দল ঝাঁপিয়েছে। টানা পনেরো বছরের বিজেপি জমানায় ১৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন শিবরাজ। তিনি সৎ বলেই পরিচিত, যদিও তাঁর জমানাই কলঙ্কিত হয়েছে ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে। কৃষকদের ক্ষোভ ও ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে কংগ্রেস কতটা সরব হয়েছে?

তিন শিবিরে বিভক্ত কংগ্রেস চেষ্টা করেছে ঐক্যবদ্ধ রূপ তুলে ধরতে। মধ্যপ্রদেশ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কমল নাথ সংগঠন দেখেছেন। প্রার্থী বাছাই করেছেন রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া এবং প্রচার করেছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং। এঁরা কেউই জনপ্রিয়তায় শিবারাজ সিং চৌহ্বানের ধারেকাছেও ছিলেন না। তবে হিন্দুত্বের কথা মাথায় রেখে নর্মদা যাত্রা, একের পর এক বৈঠক ও সভা করে গেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং, যিনি কট্টর ভাবে জ্যোতিরাদিত্যের বিরোধী বলে কংগ্রেসর অন্দরে পরিচিত।

scindia_rahul_kamal__121318091755.jpegজ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, রাহুল গান্ধী ও কমল নাথ (ইন্ডিয়া টুডে)

কমল নাথ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে গোশালা বানানোর কথা, শিবরাজের ঘোষণা ছিল পাঁচটি গ্রামপিছু একটি গোশালা বানানো। রাহুল গান্ধী গলায় পৈতে পরে কৈলাস থেকে ফিরে মধ্যপ্রদেশের মন্দিরে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপম নিয়ে তাঁরা কতটা সরব হয়েছেন?

কৃষিঋণ মকুবের কথা কংগ্রেস বলেছে। তাতেও খাস মন্দসৌরের কৃষকরা কতটা সাড়া দিয়েছেন বলা মুশকিল, অন্তত ভোটের ফল দেখে। কৃষকরা বিজেপির থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, কংগ্রেসও বহু আসনে জিতেছে নোটার ভরসায়। তা হলে বিজেপি হারল কেন?

মধ্যপ্রদেশে গ্রামীণ জনসংখ্যা ৭২.৩ শতাংশ এবং গ্রাম মানেই শুধুমাত্র কৃষকরা থাকেন এমন নয়, কৃষকদের চেয়ে কৃষিশ্রমিকদের সংখ্যা সব সময়ই বেশি হয়। সেই কৃষিশ্রমিকরা বিজেপির উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পারেন, কারণ তাঁদের জন্য আলাদা ভাবে সরকার কিছু করেনি। তা ছাড়া ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেড়গুণ হলেও বাস্তবে কৃষকের গোলা থেকে শস্য বিক্রিই হয়নি, অর্থাৎ কৃষকের আয় হয়নি, তার প্রভাব পড়েছে কৃষিশ্রমিকদের উপরেও।

উন্নয়ন বলতে যা বোঝানো হয়, মধ্যপ্রদেশে তা যথেষ্ট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে বাড়ি হয়েছে ৪৪.৫৪ লক্ষ, এই বছর প্রতি দিন রাস্তা হয়েছে ১৩৪ কিলোমিটার করে। তা সত্ত্বেও গ্রাম স্তরে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক ও আমলারা। তার প্রভাবই পড়েছে ভোটবাক্সে।

রাজ্যে কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছেন শিবরাজ সিং চৌহান। তার জন্যও রাজ্যের তরুণরা মুখ্যমন্ত্রীর প্র্তি বিরক্ত হয়ে থাকতে পারেন। ফলে তাঁরা বিজেপিকে ভোট দেননি।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ কংগ্রেস এই সুযোগ নিতে পারেনি। কোনও একজনকে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরলে বাকিরা যদি ভোটের ময়দান ছেড়ে দেন, সেই আশঙ্কায় কংগ্রেস কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলেই ধরল না, সেই সুয়োগও কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। শিবরাজ নিজেকে কৃষকের সন্তান বলে দাবি করেন, উল্টোদিকে জ্যোতিরাদিত্য রাজপরিবারের সন্তান। এই সমীকরণও কাজ করেছে। তাই কিছুটা হলেও ভোট ধরে রাখতে পেরেছে বিজেপি।

১১৪টি আসন পেয়ে বহুজন সমাজপার্টির নিঃশর্ত সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এলেও কংগ্রেসকে মনে রাখতে হবে কী ভাবে তারা বিপুল জয়ের সুযোগ হাতছাড়া করল। কর্মীভিত্তিক দল বিজেপি চেষ্টা করবে আগামী চার মাসে ঘর গুছিয়ে লোকসভা ভোটে নামতে। জয়ের আনন্দে না ভেসে কংগ্রেসের এখন উচিত লোকসভা ভোটের উপরে মনোনিবেশ করা।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment