পুজোয় টাকা দিয়ে হিন্দুদের কি কাছে টানতে চাইছেন মমতা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষত রেখে হিন্দু ভোট পেতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী

 |  4-minute read |   18-09-2018
  • Total Shares

রাজ্যের সব পুজো উদ্যোক্তাকে ১০,০০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজোয় ২৮ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করতেই রাজ্যের ২৮,০০০ পুজো কমিটিকে এই টাকা ভাগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

এই ঘোষণাকে আশ্চর্যজনক বলে মনে হতে পারে বিশেষ যে রাজ্যে দেনায় ডুবে রয়েছে সেই রাজ্যের ক্ষেত্রে, তবে এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। এই সরকারই রাজ্যে সব ইমাম ও মুয়াজ্জেনদের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেছে।

mamata-banerjee-durg_091818025233.jpgবিজেপি-কে কোনও ভাবেই হিন্দু ভোট ছিনিয়ে নিতে দেবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

তবে দিদির সর্বশেষ সিদ্ধান্তটির অন্য তাৎপর্য রয়েছে, অন্তত এ কথা বলাই যায় যে সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী। বিশেষ করে যখন আগামী বছর নির্বাচন এবং তার আগে হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে এ রাজ্যে দ্রুত বিপুল ভাবে জায়গা করে নিচ্ছে বিজেপি।

তবে কি এ সব করে নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা করছেন মমতা?

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নিজেকে মুসলমান জনসমাজের মসীহা রূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।

মুসলমান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার যে অবস্থান কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে তার বিরোধিতা থেকে শুরু করে মুম্বইয়ে অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার পরে পাকিস্তানি গায়ক গুলাম আলিকে এ রাজ্যে গানের অনুষ্ঠান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো, তিন তালাক ইস্যুতে নীরব থাকা ও রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ বা এনআরসির তীব্র বিরোধিতা করা – তাঁর প্রতিটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ তাঁর ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি ইসলাম-পন্থী সরকারের প্রধান হিসাবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনের ফলাফলেই দেখা গেছে যে রাজ্যের ২৭ শতাংশ মুসলমান ভোট তাঁর দল তৃণমূলের দিকেই রয়েছে।

বিজেপি যত বেশি করে হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকবে, মমতার পক্ষে তত সহজ হবে বিজেপিকে মুসলমান-বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরতে। তিনি মুসলমানদের তোষণ করছেন বলে যত অভিযোগ উঠবে, মুসলমান ভোট পেতে তাঁর ততই সুবিধা হবে। ভোটের মেরুকরণ তাঁর ব্যাপক সুবিধা করে দিয়েছে।

muslims-690_09171811_091818025536.jpgপশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্রমেই মুসলমান-পন্থী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠছে (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল।

তবে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোটে অন্য একটি প্রবণতা দেখা গেছে। সঙ্ঘ পরিবার ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহায়তায় তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছে বিজেপি। সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে বিজেপি তৃণমূলের পরে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বিজেপি যে এমন ফল করতে পারে তা কয়েকবছর আগেও অভাবনীয় ছিল, কারণ গ্রামবাংলার দখলের লড়াই যে কতটা রক্তক্ষয়ী সেই আন্দাজ সকলেই করতে পারেন।

এ রাজ্যের একটি বড় অংশ হলেন দরিদ্র আদিবাসীরা, যাঁরা মূলত বসবাস করেন মধ্যবঙ্গে, যে অংশ জঙ্গলমহল নামে পরিচিত এবং একসময় মাওবাদী প্রভাবিত ছিল,  এবং উত্তরবঙ্গে। দক্ষিণবঙ্গে মতুয়াদের সঙ্গে অত্যন্ত সুম্পর্ক রয়েছে তৃণমূলের। মতুয়ারা হলেন নীচু জাতের হিন্দু যাঁরা নানা নিপীড়নের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসেছেন। উত্তর ২৪ পরগনার মতো সীমান্তবর্তী জেলায় মতুয়ারা বেশ ভালো সংখ্যায় রয়েছেন। বিজেপি বারে বারেই অভিযোগ করে এসেছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের ঢুকিয়ে নেওয়ায় জনজাতির সংখ্যায় বদল আসছে, এই প্রচারের জেরে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও তারা বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রটি দখল করতে পেরেছিল।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) বিভিন্ন শাখা সংগঠন এবং দক্ষিণপন্থী বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিজেপি জন্য তিন তিল করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির কাজ এগিয়ে রাখে। আদিবাসীপ্রধান অঞ্চলে আরএসএসের সংগঠন বনবন্ধু পরিষদ ৩৫৪৩টি ‘একল বিদ্যালয়’ পরিচালনা করে। অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থানের অধীন ৩০০টিরও বেশি ‘বিদ্যা ভারতী’ বিদ্যালয় রয়েছে। আদিবাসী-প্রধান অঞ্চলে আরএসএসের স্বাস্থ্য পরিষেবা শাখা আরোগ্য ভারতী শয়ে শয়ে রয়েছে যারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে থাকে।

জাতপাতের হিসাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে আদিবাসী এলাকায় বিজেপির প্রসারের যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের মোট ৮ কোটি জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ হল তফসিলি জাতি। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গে রাজবংশী (আদিবাসী) জনজাতি ১৮.৪ শতাংশ এবং দক্ষিণবঙ্গে নমঃশূদ্র (মতুয়াদের মতো নীচু জাতের হিন্দু) জনজাতির সংখ্যা ১৭.৪ শতাংশ।

‘ভদ্রলোক’ বলে পরিচিত উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুদেরও মমতার প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে, কারণ রাজ্যে নতুন করে শিল্পের সম্ভাবনা তৈরির করার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ হয়েছেন। এই অবস্থায় তাঁর খোলাখুলি মুসলমান তোষণ মধ্যবিত্তদেরও তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই এ কথা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়।

তাঁর সঙ্গে জেহাদি মুসলমানদের যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি শাখাও ক্রমাগত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মুমতাজ বেগম’ বলে আক্রমণ শানিয়ে আসছে। এই অবস্থায় বাধ্য হয়েই ২০১৯ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেসকেও আইটি শাখা চালু করতে হয়েছে।

এই সব তথ্য একত্রিত করলে একটা ব্যাপার প্রমাণিত হয়েই যায়, রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপির উত্থানে যদি এই রাজ্যের কোনও একজন চিন্তিত হয়ে থাকেন তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান ছাড়া অন্য কেউ নন।

বাঙালি হিন্দুপ্রধান ত্রিপুরা বিজেপির দখলে চলে যাওয়ায় তাঁর দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। তিনি জানেন যে গেরুয়া পার্টিটির ক্ষমতাও আছে, টাকাও আছে। অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এখন আর গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কের ব্যাপারে উদাসীন থাকা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যখন রাজ্যের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক ক্রমাগত তাঁর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মেরুকরণ হওয়ার ফলে প্রাথমিক ভাবে তিনি সুবিধা পেয়েছিলেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর জন্য তাঁকে মূল্য চোকাতে হচ্ছে।

তড়িঘড়ি সবদিকে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই তিনি দুর্গাপুজোর জন্য বেশ কয়েক কোটি টাকা দিচ্ছেন এবং তাঁর দলের লোকজনকেও নির্দেশ দিয়েছেন সক্রিয় ভাবে রামনবমীতে যোগ দিতে। তাই মহরম মাসের শুরুতেই তৃণমূলের নেতারা ও উলেমারা যা বলছেন এ বার যেন অস্ত্র হাতে কেউ না বার হন তাতে স্পষ্ট যে বিজেপির হাতে আর নতুন করে কোনও অস্ত্র তুলে দিতে চাইছে না তৃণমূল কংগ্রেস।

মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখার জন্য এখন আর হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে হালকা ভাবে নিচ্ছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

INDRAJIT KUNDU INDRAJIT KUNDU @iindrojit

The writer is principal correspondent, India Today TV and AajTak.

Comment