কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই মমতার বিরুদ্ধে যাওয়ায় কেন লোকের আবেগ মমতার দিকে
খাঁচায় বন্দি তোতা দীর্ঘ দিন ধরে কোনও রাজনীতিকের পক্ষে বা কখনও বিপক্ষে বলেছে
- Total Shares
কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) আধিকারিকদের প্রবেশের চেষ্টার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্নায় বসলে তিনি সারা দেশ থেকে বিরোধী নেতানেত্রীদের পাশে পেয়েছিলেন।
কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারস্বামী টুইটে লেখেন:
#MamataVsCBI | “What happened in West Bengal is an attack on a state’s federal rights guaranteed by our constitution. We stand with West Bengal chief minister Mamata Banerjee,” Karnataka CM @hd_kumaraswamy tweeted this morning.Follow LIVE updates here:https://t.co/D0XtmVFXmO pic.twitter.com/avt9h9RSEh
— Hindustan Times (@htTweets) February 4, 2019
রাষ্ট্রীয় লোকদলের (আরএলডি) সহ-সভাপতি জয়ন্ত চৌধরী টুইটে লেখেন:
Distressed by the news out of Bengal. A complete breakdown of trust in institutions under an authoritarian Modi Govt obsessed with regaining power at all costs. Mamata Ji is resisting & has the support of all those who understand the agenda behind these moves.
— Jayant Chaudhary (@jayantrld) February 4, 2019
অন্য আলোচনা স্থগিত রেখে "সিবিআই-এর অপব্যবহার" নিয়ে আলোচনা দাবি করে রাজ্যসভায় নোটিস দেন আম আদমি পার্টির (আআপ) সাংসদ সঞ্জয় সিং।
পুরো বিষয়টিকে "রাজনৈতিক প্রতিহিংসা" আখ্যা দিয়ে তেলুগুদেশম পার্টির প্রধান এন চন্দ্রবাবু নাইডু বলেন, “যাঁরা বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি তাঁদের মামলায় ফাঁসাচ্ছে বিজেপি। যারাই বিজেপির বিরোধিতা করছে তাদের বিরুদ্ধেই ওরা পুরোনো মামলা খুঁচিয়ে তুলছে। সম্প্রতি কলকাতায় জনসভা সফল হয়েছে, তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা... কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ওরা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত করে দিচ্ছে... অন্য বিরোধীদলদগুলির সঙ্গে তেলুগুদেশম পার্টির সাংসদরাও সিবিআই ইস্যু নিয়ে আজ তীব্র প্রতিবাদ করবে।” (তখন বলেছিলেন)
রাষ্ট্রীয় জনতাদল (আরজেডি) নেতা মনোজ ঝা বলেকেন, অলোক ভার্মা নিয়ে যা হয়েছে তার পরে আর সিবিআইয়ের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। নির্বাচনের পরে আমরা দেখব কে জেলে যায়।”
তামিলনাড়ুর সাংসদ কানিমোঝি টুইট করেন:
Anyone who cares for Democracy, Federalism and Constitution must stand with Ms @MamataOfficial. மாநில உரிமைகளை காக்க,அரசியலமைப்பு சட்டத்தை பாதுகாக்க மம்தா பானர்ஜி அவர்களின் போராட்டத்தை ஆதரிப்பது நம் கடமை. #SaveDemocracy pic.twitter.com/8uCXy8bpFv
— Kanimozhi (கனிமொழி) (@KanimozhiDMK) February 4, 2019
সারদা চিট ফান্ড ও রোজভ্যালি দুর্নীতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করা হয়েছিল তার প্রধান রাজীব কুমারের শেক্সপিয়ার সরণির বাড়িতে কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই হাজির হয়ে যায় ৪০-সদস্যের সিবিআই দল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মানিক মজুমদারের বাড়িতে সিবিআই গিয়েছিল ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দুই সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন ও সুব্রত বক্সীকে তারা নোটিস পাঠিয়েছে।
সলিসিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া ৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে বলেছিলেন, “আমরা আশঙ্কা করছি যে বৈদ্যুতিন প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হতে পারে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেন যে, “কলকাতা পুলিশ যে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে ফেলছে এমন কোনও প্রমাণ নেই... প্রমাণ দিন এবং যদি দেখি যে পুলিশ কমিশনার কখনও প্রমাণ নষ্ট করার কথা ভেবেছেন তা হলেও আমরা এমন পদক্ষেপ করব যে তাঁকে পস্তাতে হবে।”
কলকাতার পুলিশপ্রধান দোষী হন বা না হোন – ঘটনা যাই হোক না কেন তাঁকে আইনের নির্দিষ্ট ধারার মধ্যেই কয়েকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, সেগুলি এই রকম:
আমার মতে, বেআইনি ভাবেই পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই প্রবেশ করেছে। ঘটনা হল, তল্লাশি করার কোনও পরোয়ানা বা আদালতের কোনও পরোয়ানা ছাড়াই জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য হাজির হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ওই নির্দিষ্ট মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে যে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের প্রধানকে জিজ্ঞাসাবাদ/ গ্রেফতার করা যাবে না।
আরও বড় কথা হল, সংবিধানের সপ্তম তফসিলের কারেন্স লিস্টে আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি রয়েছে। এটি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত।
নীতি আয়োগ পরামর্শ দিয়েছে আন্তঃরাজ্য অপরাধ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি রোধ করতে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাকে কারেন্ট লিস্ট থেকে সরিয়ে দিতে, যদিও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
নীতি আয়োগ পরামর্শ দিয়েছে আন্তঃরাজ্য অপরাধ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি রোধ করতে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাকে কারেন্ট লিস্ট থেকে সরিয়ে দিতে, যদিও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। (উৎস: পিটিআই)
স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রকম ভাবনাচিন্তা না করেই এ কাজ করছে।
সুস্পষ্ট অনুমতি ছাড়া ২৯টি রাজ্যের কোথাও কাজ করতে পারে না সিবিআই। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে তাদের রাজ্যে সিবিআইয়ের কাজ করার অনুমোদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ।
দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট মোতাবেক কাজ করে সিবিআই। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে গৌহাটি হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে সেই নির্দেশ মোতাবেক ১৯৬৩ সালে যে প্রশাসনিক নির্দেশে সিবিআই গঠিত হয়েছিল সেই নির্দেশটি অসাংবিধানিক এবং সেই আইনটিও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাস করা হয়েছিল। আদালতের দৃষ্টিতে, “ডিএসপিই অ্যাক্ট, ১৯৪৬ বৈধ কিনা সে ব্যাপারে সব তথ্য খতিয়ে দেখে আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ডিএসপিই-র কোনও অঙ্গ বা অংশ নয় সিবিআই এবং এটি ডিএসপিই অ্যাক্ট, ১৯৪৬ অনুযায়ী গঠিতও হয়নি। এই উপসংহারের শুরুতে বলা যায় যে, এটি ডিএসপিই অ্যাক্ট, ১৯৪৬-এর বৈধ অংশ নাকি বৈধ অংশ নয় সেটি সম্পূর্ণ ভাবে তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় হতে পারে।”
নবেন্দ্র কুমার বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার রিট মামলায় বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি ও ইন্দিরা শাহের ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, “রেজলিউশন নম্বর ৪/৩১/৬১ তাং ১/৪/১৯৬৩ যেটি ভারত সরকারের সচিব ভি বিশ্বনাথনের জারি করেছিলেন, তাতে সিবিআইকে মহাক্ষমতাশালী হিসাবে দেখানো হয়েছে। সিবিআই দ্য দিল্লি স্পেশ্যাল পোলিস এস্ট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্টের কোনও অঙ্গ বা অংশ নয় এবং সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী সিবিআইকে পুলিশ বাহিনীর অংশ হিসাবে বিবেচনাও করা যাবে না।”
তবে সিবিআইয়ের গঠন অসাংবিধানিক বলে এবং ১৯৬৩ সালের প্রশাসনিক যে নির্দেশে সিবিআই নামক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল সেই নির্দেশিকাকে বাতিল করে দিয়েছিল সেই নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিষয়টি পুনরায় খতিয়ে দেখে সুপ্রিম কোর্ট।
সুতরাং এই মামলা অনুযায়ী সিবিআইয়ের ইচ্ছামতো ও কারও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে তাদের ব্যবহার করা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে আক্রমণের সামিল। সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যে ভাবে মরিয়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে হয়রান ও অপদস্থ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে হলে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে বলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে এ রাজ্যে প্রবেশের অনুমোদন ও অমিত শাহের রথযাত্রার অনুমোদন বারে বারে বাতিল করার পর এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছে।
যাই হোক, বিষয়টিকে এ ভাবে দেখা যেতে পারে যে বিগত পাঁচ বছর ধরে সংবিধানের ঘোলাজলে মাছ ধরার যে অভ্যাস নরেন্দ্র মোদী সরকার করে ফেলেছে এটা তারই একটা অংশ তা সে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকার বিরুদ্ধে গিয়ে আনন্দ তেলতুম্বড়েকে গ্রেফতার করাই হোক, রীতিনীতি মাত্রা লঙ্ঘন করে নির্বাচনের তিন মাস আগে পূর্ণ বাজেট পেশ করাই হোক (এবং পরে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করা) অথবা সংবিধানস্বীকৃত ৫০ শতাংশের মাত্রা আপাত ভাবে লঙ্ঘন করে অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সংরক্ষণ দেওয়া।
একদিন বিচারপতি লোধা সিবিআই-কে যে খাঁচায়বন্দি তোতার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সেটা একেবারেই সত্যি এবং পরবর্তী সরকারও তার অপব্যবহারই করছে।
জরুরি অবস্থার সময় রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দু'লক্ষ এফকআইআর দায়ের করা হয়েছিল। যাঁরা অন্তরীণ হয়েছিলেন তাঁদের আটক করা হয়েছিল মেন্টেন্যান্স অফ ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (মিসা) এবং ডিফেন্স অফ রুলস – যে দুটি প্রয়োগ করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার সময়ে।
রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হয় বলে 'খাঁচায় বন্দি তোতা' আখ্যা পেয়েছে সিবিআই। (উৎস: পিটিআই)
পুলিশ যত এফআইআর দায়ের করেছিল সে মোটামুটি একই রকম ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল কোনও দুধের ডিপোয় অথবা বাসস্ট্যান্ডে তাঁরা বক্তৃতা করছিলেন কী ভাবে ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে ফেলে দেওয়া উচিত। কাউকে গ্রেফতার করার কোনও কারণ প্রয়োজন হত না।
জরুরি অবস্থার সময় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার বড় অস্ত্র ছিল সিবিআই।
২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউপিএ সরকার দেখিয়ে দিয়েছে কী ভাবে সিবিআই-এর অপব্যবহার করা যায়।
এখনও হয়তো অনেকে মনে করতে পারবেন, গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ডিএমকে প্রধান এম করুণানিধির ছোট ছেলে তথা রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এমকে স্ট্যালিনের চেন্নাইয়ের বাড়িতে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে কী ভাবে তল্লাশি করা হয়েছিল। সময়টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে ডিমএমকে মন্ত্রীরা ইস্তফা দেওয়ার দিনই স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্ট্যালিনের বাসভবন-সহ তামিলনাড়ুর ১৯টি জায়গায় তল্লাশি করে সিবিআই।
সেই খাঁচায় বন্দি তোতা এখন মোদী সরকারের হাতে।
তবে সময় বদলেছে।
সম্প্রতি যে নাটকটি হল তাতে আর কারও নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই লাভ হল, যিনি পরিকল্পনাহীন ভাবে ধর্নায় বসেছিলেন একটা প্লাস্টিকের চেয়ার গায়ে হালকা বাদামি রঙের শাল গায়ে দিয়ে, এবং জানতেন লোকের আবেগ তাঁর দিকেই ঢলে পড়বে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে