আমার নাম বনাম তোমার নাম: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষিপ্ত কেন?

নতুন হোক বা পুরোনো, নাম পরিবর্তনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সিদ্ধহস্ত

 |  4-minute read |   19-11-2018
  • Total Shares

তাঁর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে বদলে শুধুই 'বাংলা' রাখা হোক। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবতম অভিযোগ, বিজেপি তাঁর এই সিদ্ধান্তকে রূপায়িত করতে বাধা সৃষ্টি করেছে, অথচ নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের জন্য একের পর এক ঐতিহাসিক জায়গার নাম পাল্টে চলেছে।

জায়গার নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কি বিজেপি দ্বিচারিতা করছে? এই প্রশ্নের উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, "মাতৃভাষা বাংলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে বিধাসভায় সর্বসম্মত ভাবে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাব দীর্ঘদিন দিন ধরে কেন্দ্র আটকে রেখে দিয়েছে। এর ফলে এ রাজ্যের মানুষ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।"

বিজেপির দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর এই নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'। তাই বিজেপি এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার হুমকি দিয়েছে।

দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জানিয়েছেন, "বাংলার মানুষ কি এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে? কিছু লোক রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের লক্ষে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করতে চাইছে। আমরা কোনও মতেই তা হতে দেব না।"

body_111918015838.jpgকেন্দ্রের উপর ক্ষিপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় [ছবি: রয়টার্স]

এই দড়ির লড়াইয়ের মাঝে দিদি স্পষ্ঠতই ক্ষিপ্ত। এই ভরা নির্বাচন মরসুমে তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর কাছ থেকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার কেড়ে নিয়েছে।

তিনি, খুব দ্রুত, ফেসবুকে জবাবও দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, "এ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা হবে কিনা তা কি এমন একটি রাজনৈতিক দল ঠিক করবে, যাদের এই রাজ্যে কোনও অস্তিত্বই নেই? না কি, সংবিধান মেনে রাজ্যের বিধানসভায় পাস হওয়া সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে সম্মান দেওয়া হবে।"

তা হলে, ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম পরিবর্তন নিয়ে বিরোধিতা করেন না। উল্টে, তিনি নাম পরিবর্তনকে সমর্থন করেন।

মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানাচ্ছেন, "স্বাধীনতার পরে কিছু শহর ও রাজ্যের নাম পরিবর্তন হয়েছে। যেমন উড়িষ্যার নাম ওড়িশা হয়েছে, পন্ডrচেরীর নাম পুদুচেরি হয়েছে, মাদ্রাসের নাম চেন্নাই হয়েছে, বম্বের নাম মুম্বাই হয়েছে, ব্যাঙ্গালোরের নাম বেঙ্গালুরু হয়েছে। এই নাম পরিবর্তন কিন্তু স্থানীয় মানুষদের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে।" বরঞ্চ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বিজেপির এই নতুন নাম পরিবর্তনের খেলা 'খেয়াল খুশি' মতো।

কিন্তু নাম পরিবর্তনের আসরে আরও অনেকগুলো 'ফ্যাক্টর' রয়েছে। দিদির ঘনিষ্ঠরা জানেন যে তিনি কী ভাবে শব্দ নিয়ে খেলা করতে পারেন এবং রাজ্যে বেশ কিছু পুরোনো ও নতুন নাম ইতিমধ্যেই পরিবর্তন করে ফেলেছেন। রাস্তা থেকে রেল স্টেশন, জলের ট্যাঙ্ক, ফ্লাইওভার, এমনকি রাজ্যের নতুন সচিবালয় 'নবান্ন' - সব কিছুর নামকরণই দিদির ব্যক্তিগত চিন্তার ফসল।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই নামকরণ করার 'ভূত' মাথায় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মাথায় চেপেছে। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ সালে বেশ কয়েকটি মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করেছিলেন তিনি। প্রতিটিই বাংলার মনীষীদের নামে।

২০১৪ সালে বাংলার প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিদি সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার একটি গুরত্বপূর্ণ রাস্তা তাঁর স্মৃতিতে উৎসর্গ করতে উদ্যোগী হলেন। এর ফলে, সিদ্ধান্ত হল, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নাম হবে সুচিত্রা সেন সরণি। কিন্তু, দেখা গেল, এই রাস্তাটির বর্তমান নাম প্রমথেশ বড়ুয়া সরণি, বিখ্যাত চিত্র পরিচালকের নামে।

body1_111918020558.jpgরাজ্যের সচিবালয়ের নাম নবান্ন রেখেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী [সৌজন্যে: টুইটার]

দিদির ইচ্ছেপূরণ করতেই হবে। তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত কলকাতা পুরসভা এবার একটি নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা প্রয়োগ করল - আড়াই কিলোমিটার রাস্তার নাম দু'জন কিংবদন্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল। তবে, বড়ুয়ার ভাগ্য মাত্র ৩৫০ মিটার জুটলো।

বাংলার আর একজন মনীষী সত্যজিৎ রায়ও সম্প্রতি দিদির নাম পরিবর্তনের বাতিকের শিকার হলেন। কয়েক দশক ধরে সত্যজিৎ রয়ের বাড়ির রাস্তাটির নাম ছিল বিশপ লেফ্রয় রোড। কিছুদিন আগে ওই রাস্তার সৌন্দর্যায়ন হয়। আর, সেই সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের সরকরি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েই একটি নতুন চিন্তা পেয়ে বসল মুখ্যমন্ত্রীকে।

আর, দিদির সেই চিন্তা বাস্তবে রূপায়ণ করতে বিশপ লেফ্রয় রোডের লাগোয়া রাস্তা লি রোডের নামকরণ করা হল সত্যজিৎ রায় ধরণী। বাংলা অভিধানে 'সরণি' মানে রাস্তা। তাই প্রচুর রাস্তার নামের সঙ্গে 'সরণি' শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ধরণী মানে তো পৃথিবী। মমতার সমর্থকরাও এই নামটি নিয়ে বেশ অবাক হয়েছিলেন।

এর পর, মধ্য কলকাতা থেকে বাইপাস সংযোগকারী পরমা আইল্যান্ড ফ্লাইওভারের উদ্বোধন হল। বাম আমলে প্রস্তাবিত এই ফ্লইওভাটির সেই সময়কার প্রস্তাবিত নামকরণ করা হল না। বরঞ্চ, মমতার ইচ্ছেতে এই ফ্লাইওভারের নামকরণ হল মা।

এবার আসা যাক মুখ্যমন্ত্রীর সাহিত্য চর্চাতে। তিনি প্রচুর বই লিখছেন। তার মধ্যে একটি বইয়ের নাম নামাঞ্জলি। রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলির সঙ্গে মিলিয়ে। বইটির বিষয়সূচি কী? সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়া পিতা মাতারা এই বই পড়ে সন্তানদের নামকরণ করতে পারবেন। নামাঞ্জলির নামকরণের কারণ তা এবার বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।

এর পরেও যদি কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে বাংলা করতে বাধা দেয় তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষিপ্ত হতেই পারেন। তাঁকে কি আর দোষ দেওয়া চলে!

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

INDRAJIT KUNDU INDRAJIT KUNDU @iindrojit

The writer is principal correspondent, India Today TV and AajTak.

Comment