মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের কাঁটা কংগ্রেস নাকি মায়াবতী?
কংগ্রেসের উত্থান ও মায়াবতীর ক্ষমতাবৃদ্ধি মমতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে কাঁটা বিছিয়েছে
- Total Shares
পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের উত্থান কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে? পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফল বার হওয়ার প্রাক্কালে অবিজেপি দলগুলি জোট করার ব্যাপারে দিল্লিতে যে ‘গোলটেবিল বৈঠক’ করেছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে মধ্যমণি ছিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকে মায়াবতীও ছিলেন না। তবে এক-দুই আসনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া কংগ্রেসকে মধ্যপ্রদেশে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন বহুজন সমাজপার্টির (বিএসপি) নেত্রী মায়াবতী। সমর্থন দিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির (সপা) প্রধান অখিলেশ যাদবও।
নির্বাচনের বিজেপির পরাজয়ে খুশি হয়ে টুইট করেছেন তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কৃষকদের পাশাপাশি তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং অন্য অনগ্রসর শ্রেণীর প্রতি বিজেপির বঞ্চনার অভিযোগও তুলেছেন। সঙ্গে নাম না করে স্বাগত জানিয়েছেন বিজয়ীদের।
Victory of democracy and victory against injustice, atrocities, destruction of institutions, misuse of agencies, no work for poor people , farmers, youth, Dalits, SC, ST, OBC, minorities and general caste 2/3
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) 11 December 2018
কাঁটা এখানেই। দ্বিতীয় কাঁটা কংগ্রেস হলে তাঁর প্রথম কাঁটা মায়াবতী। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার পাশাপাশি অসমের পঞ্চায়েত ভোটের ফল পাশাপাশি রাখলে বোঝা যাবে কেন কংগ্রেসের থেকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বড় কাঁটা মায়াবতী।
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে স্পষ্ট যে ক্ষমতা অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছেন মায়াবতী। ছত্তিশগড়ে আদিবাসী-প্রধান এলাকায় মায়াবতী বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছেন। যে সব জায়গায় জয়ী হতে পারেননি, সেখানে বিজেপির থেকে আদিবাসী ভোট কেটে কংগ্রেসকে জিততে সাহায্য করেছেন। আর মধ্যপ্রদেশে শেষবেলায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে দু’টি আসন কম পাওয়া মায়াবতী নিঃশর্ত সমর্থন করে দিয়েছেন। এখন নিঃশর্ত সমর্থন করলেও লোকসভা ভোটের সময় যে কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের থেকে আসন চেয়ে বসবেন না, একথা কেউ বলতে পারেন না।
উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী জোট গড়তে রাজি, তবে তাঁর ৪০টি আসন চাই। ৮০টি আসন বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশে অর্ধেক আসন তিনি নিলে বাকি অর্ধেক আসন ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে হবে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদল ও কংগ্রেসের মধ্যে। মায়াবতী আসন সমঝোতার সময় খুব একটা নরম মনোভাব দেখাবেন বলে মনে হয় না, অন্তত সাম্প্রতিক কালে দেখাননি।
বাঁ দিক থেকে মায়াবতী, সনিয়া গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ও রাহুল গান্ধী (ছবি: ফাইল/পিটিআই)
কিন্তু এই সব কাটাছেঁড়ার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাববেন কেন?
যদি এই পাঁচ রাজ্যের ফল আগামী লোকসভা নির্বাচনের ফলের আভাস না হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে বিজেপি ক্ষমতায় আসছে এবং তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তখন আঞ্চলিক দলগুলির সহায়তা নিয়ে সরকার গড়বে, সেই সরকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হবেন নাকি অন্য কেউ তা ঠিক করবে বিজেপি ও সহযোগী দলগুলি। কিন্তু এই ফলাফল যদি লোকসভা ভোটের আভাস হয়, তা হলে কী হবে?
লোকসভা ভোটে এই ফলাফলের ছাপ দেখা গেলে বলতে হবে কংগ্রেসই হবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তারা হয় অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়বে, না হলে তারা একটি জোটকে সমর্থন করবে সরকার গড়ার জন্য। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও রাজীব গান্ধী নিজে সরকার না গড়ে চন্দ্রশেখরকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন সরকার গড়ার জন্য।
যদি জোট সরকার গড়ে তা হলে সেই জোটের প্রধানমন্ত্রী তাঁরই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যিনি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশের সবচেয়ে বেশি আসন যে সব রাজ্যে রয়েছে সেই তালিকার পশ্চিমবঙ্গ তিন নম্বরে – উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের পরে। মহারাষ্ট্র বিজেপির শক্ত ঘাঁটি, তাই সেখান থেকে শরদ পওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি বা উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার ৪০টির বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেলই চলে।
রাহুল গান্ধীই কি এখন বিরোধীদের নেতা? (ছবি: ফাইল/রয়টার্স)
পশ্চিমবঙ্গ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বাধিক ৪২টি আসন পেতে পারেন। এই অবস্থায় তিনি লোকসভায় আসন বাড়ানোর লক্ষে অসমে বাঙালি ভাবাবেগের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীকরণের বিরোধিতা করতে শুরু করেন, অসমে তৃণমূল প্রতিনিধিদল পাঠান এবং পঞ্চায়েত ভোটে বাঙালি-প্রধান এলাকায় রাজ্যের নেতাদের পাঠিয়ে প্রচার করান। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝে গেছেন অসম থেকে লোকসভা আসনে জয় সম্ভব নয়। উত্তরপূর্বে অন্য রাজ্যগুলিতেও একই অবস্থা তৃণমূলের।
মুকুল রায় তৃণমূল কংগ্রেস থাকাকালীন তিনি দল ভাঙিয়ে তৃণমূলের জন্য জমি তৈরি করছিলেন। এখন তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় উত্তরপূর্বে সংগঠন বাড়ানোর মতো তৈরি নেতা তৃণমূলের হাতে নেই, অন্তত ভোটের ফল (ত্রিপুরায় বিধানসভা ভোট ও অসমে পঞ্চায়েত ভোট) সে কথাই বলছে।
ইতিমধ্যেই তিনি ঝাড়খণ্ডে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, ঝাড়খণ্ডেও বহু বাঙালি থাকেন। ঝাড়খণ্ডের বাঙালিরাও কেউ প্রবাসী নন, তাঁরা ঝাড়খণ্ডেরই বাসিন্দা, তাই সেখানেও তিনি যে খুবএকটা সুবিধা করতে পারবেন না বলাই যায়। ঝাড়খণ্ডে স্থানীয় দল রয়েছে একাধিক, তাই পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় দলের পক্ষে সেখানে প্রভাব বিস্তার করা মুশকিল।
রাজনৈতিক অঙ্কের সঙ্গে বাস্তব অনেক সময়ই মেলে না, তবুও যে অঙ্ক এক একটি নির্বাচনের আগে কষা হয়, সেই অঙ্কের হিসাব অনুযায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে জোটের নেত্রী হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়া দূর অস্ত্।
রাজ্যে এসে নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে ফেডেরাল ফ্রন্টের কথা ঘোষণা করেছিলেন তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতির প্রধান তথা তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও। তিনি এখন আরও বেশি আসন নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি অকংগ্রেসি-অবিজেপি জোটের পক্ষে সওয়াল করছেন। কিন্তু পাশে পাবেন কাকে?
ছেলে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে নিয়ে ডিএমকে নেতা ও তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির মূর্তি উদ্বোধন করলেন সোনিয়া গান্ধী, তাঁদের মাঝে করুণানিধির ছেলে তথা ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন ও (বাঁদিকে) কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন (ছবি: টুইটার /@INCIndia)
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা তেলুগুদেশম পার্টির (টিডিপি) প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে এখন কংগ্রেসের সঙ্গে, কংগ্রেসের সমর্থনে জনতা দল-সেকুলার (জেডিএস) সরকার চালাচ্ছেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারস্বামী। দক্ষিণের ডিএমকে নেতা স্ট্যালিনের সঙ্গে বোঝাপড়া চলছে কংগ্রেসের। নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল (ওড়িশা) ও উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। বাকিরাও হয় কংগ্রেস না হয় বিজেপির সঙ্গে।
জানুয়ারি মাসে ব্রিগেডে দেশের তাবড় নেতাদের আনছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তার আগে তিন রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের শপথে কারা যোগ দিচ্ছেন তাতেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে আগামী বছর লড়াইটা কেমন হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভাবনা কতটা।