ক্ষমতা নেই নির্বাচন কমিশনের, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করছে শাসকদলই
পুলিশকে দিয়ে ভাড়াটে গুণ্ডার কাজ করাচ্ছে শাসকদল, তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিরোধী প্রার্থীদের
- Total Shares
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ। সাংবিধানিক পদে যাঁরা আসীন হন তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হল নিজের পদের মান ও মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংবিধান মেনেই সাংবিধানিক পদে কাজ করতে হয়।
সাংবিধানিক পদে থেকে কেউ যদি সংবিধানে বর্ণিত দায়িত্ব পালন না করেন, তা হলে শুধু নিজের পদ ও দায়িত্বের অমর্যাদাই তিনি করবেন না, তাঁর সেই আচরণ হবে সংবিধানকে অবমাননার সমতুল্য।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হল গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচন পরিচালনা করা, নির্বাচন প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে পরিচালনা করা এবং এমন সন্দেহাতীত ভাবে কাজ করা যাতে কেউ পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলতে না পারেন। এই দায়িত্ব পালনের যাঁর উপরে ন্যস্ত, অর্থাৎ যিনি সেই প্রতিষ্ঠানকে অলঙ্কৃত করছেন, তাঁকে সেই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষার জন্য মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হয়। যে ব্যক্তি এই আসন অলঙ্কৃত করেন, তাঁর যেন কোনও পুরস্কারের মোহ অথবা শাস্তির ভয়, কোনওটাই না থাকে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে যাতে তিনি কাজ করতে পারেন সে জন্য সংবিধান তাঁকে ক্ষমতা ও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্র সিংয়ের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে
পঞ্চায়েত ভোট এমন, যেখানে গণতন্ত্র সমাজের শিকড় পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সমাজের প্রান্তিকজনও এই ব্যবস্থার অংশীদার।
পঞ্চায়েত আইন ও পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলে কাজ করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তার কারণ হল, শাসক দল চাইছেই না যে ভোটে মানুষ অংশগ্রহণ করুক। অন্য ভাবে বলতে গেলে, তারা গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচন চায় না। এ জন্য তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল, মনোনয়ন দাখিল করতে দেবে না। নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ যাতে ভোগে সে জন্য গুণ্ডাবাহিনী তো ছিলই, একই সঙ্গে পুলিশের উপরের তলার আধিকারিক, মাঝারি স্তরের আধিকারিক ও নীচুস্তরের একটা বিশাল অংশকে তারা ‘নিয়োগ’ও করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, মনোনয়ন যেন জমা দিতে না পারে প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
আমরা অভিযোগ পেয়েছি, মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় পর্যন্ত অনেক জায়গায় পুলিশের এসপি, ডিএসপি, আইসি-দেরও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মিথ্যা মামলার ভয় দেখানো হয়েছে, কোনও মামলা ছাড়াই প্রার্থী, তাঁর আত্মীয়স্বজন বা পরিবারকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে তৃণমূলের নেতাদের সামনে হাজির করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রথমে মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য পীড়াপীড়ি করা, কাজ না হলে জোর করা, শেষে ভয় দেখানো বা ব্ল্যাকমেল করা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে পুলিশের গাড়িতে প্রার্থীকে তুলে নিয়ে গিয়ে তৃণমূলের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে।
কাজ হাসিল করার জন্য ভাড়াটে গুন্ডা নিয়োগের কথা শোনা যায়। এই সব গুণ্ডারা বন্দুকের ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করে। ভোটের ময়দানেও সেই একই ভাবে প্রার্থীকে তুলে নেওয়ার জন্য পুলিশকে দিয়ে ভাড়াটে গুণ্ডার কাজ করাচ্ছে রাজ্যের শাসকদল। এই ঘটনা যেমন পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে তেমনই নির্বাচন কমিশেনের নিরপেক্ষতাকে অনেক বেশি হাস্যস্পদ করে দিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় কোথাও মনে হয়নি যে এ রাজ্যে নির্বাচন কমিশন বলে আদৌ কিছু আছে।
নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে আরও (রিটার্নিং অফিসার) এবং এআরও (অ্যাসিস্ট্যান্টরিটার্নিং অফিসার) আছেন তাঁরা নির্বাচন কমিশনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন না, তাঁরা স্থানীয় তৃণমূলী, ব্লক তৃণমূলের সর্বোচ্চ কর্তা এবং মন্ত্রী বা নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের একটা তারিখ ঠিক করতে পারছেন না।
গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সরব বিরোধীরা (পিটিআই)
নির্বাচনের প্রার্থীপদ এবং নির্বাচন কর্মীদের এবং ভোটারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয়, সে জন্য নির্বাচন কমিশনার তাঁর পদমর্যাদা ব্যবহার করে এবং যে সাংবিধানিক অধিকার তাঁর উপরে ন্যস্ত রয়েছে তা ব্যবহার করে তাঁরা রুখে দাঁড়াতে পারেন। আমরা মীরা পাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখেছি তিনি সরকারের প্রবল চাপ সত্ত্বেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা সুশান্ত উপাধ্যায়কেও দেখেছি তিনি মেরুদণ্ড জমা দিয়েছিলেন কালীঘাটে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি, মন্ত্রীরা ভয় দেখিয়ে পদত্যাগ করিয়ে দিয়েছিলেন।
এখানেও মনোনয়নে একটা দিন বাড়তি দেওয়ার পরেও শুধু পুলিশ এবং তৃণমূলের হুমকিতে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আবার সেটাকে রাতারাতি প্রত্যাহার করে নিলেন। পরে হাইকোর্টে চপেটাঘাত। এমনতি আমরা চাই না বিচারব্যবস্থা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুক। কারণ আমাদের সংবিধানে সকলের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। কিন্তু কেউ যদি নিজের দায়িত্ব পালন না করেন তা হলে সাধারণ মানুষকে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিচারব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।
এখন পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তাতে নির্ধারিত দিনে ভোটগ্রহণ হবে কিনা, হলে কী ভাবে হবে, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কোনও হাত নেই, এই দায়িত্ব অনেকটা স্থানীয় তৃণমূলী গুণ্ডাদের হাতে তুলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আমরা যাকে বলি গণতন্ত্রের মন্দির, অর্থাৎ সংসদ, বিধানসভা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং সেই মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া শুধু নয়, পূজারীর ভূমিকা পালন করা হল নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু এখানে সেই পূজারী তিনি ভক্তদের আহ্বান জানাচ্ছেন যেন তাঁরা মন্দিরের দুয়ারে আসেন, কিন্তু সেখানে তিনি তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না, কারণ সেই মন্দির থেকে গণতন্ত্রের বিগ্রহ সরিয়ে সেখানে শাসকদলের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নির্দেশও তাঁর কাছ থেকে নিচ্ছেন।