পুলওয়ামা জঙ্গিহানা: উচিত শিক্ষা পেলেই পাকিস্তানের অপরাধপ্রবণ মানসিকতা বদলাবে

পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বেশ ভীরু দেখিয়েছে ভারতকে, 'শান্তি চাই' মনোভাব বদলাতে হবে

 |  6-minute read |   19-02-2019
  • Total Shares

আমরা আমাদের প্রতিবেশী বদল করতে পারব না। কিন্তু স্বভাব পরিবর্তন তো করতেই পারি। ধারাক্রমে এবং চিকিৎসাশাস্ত্র মেনেই তা করতে হবে।

বহু যুগ ধরেই পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদকে ভারত নিজের ভবিতব্য বলে মনে করে এসেছে। প্রতিটি জঙ্গি হানার পরেই নিয়ন্ত্রণরেখার বরাবর গুলি চালিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে ভারত। এই গুলি বিনিময়ে বেশ কিছু জঙ্গি নিহত হয়। পাকিস্তান অবশ্য এই জঙ্গিদের 'খরচের খাতায়' ধরে। মাঝে মাঝে অবশ্য ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে পাকিস্তানী সৈনিক কিংবা রেঞ্জাররা প্রাণ হারায়।

তবেকিছুদিনের মধ্যেই গুলির শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায়। সবকিছুই আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

উরি হামলার পর পাকিস্তানের জঙ্গি শিবিরগুলোর উপর ভারত সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছিল। কিন্তু পুলওয়ামার পর একটি কী দুটি সার্জিকাল স্ট্রাইক দিয়ে আরে চিঁড়ে ভিজবে না।

body_021919015256.jpgপুলওয়ামা হামলার পরেও ওয়াগা সীমান্ত বলিউড বাজার রয়ে গিয়েছে [ছবি: পিটিআই]

ওয়াগা কিংবা অন্যান্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই ঘটেনি। পাকিস্তানের 'মোস্ট ফেভারড নেশন' (এমএফএন) তকমা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেই দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে চলেছে। নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান হয়েই চলেছে। পাকিস্তান মদতপুষ্ট জিহাদিদের ব্যবহারের জন্য বিস্ফোরক ও গ্রেনেড খুব সহজেই এই অসুরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে এদেশে ঢুকে পড়ছে, যেখানে নিত্যদিন পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এই সীমান্তগুলোর নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র না করে এই সীমান্তগুলোকে বলিউডের বাজারে পর্যবসিত করে তোলা হয়েছে। যেখানে কান পাতলেই লাউডস্পিকারে বলিউডের গান শুনতে পাওয়া যায়।

যে দেশগুলো নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয় সেই দেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন হতেই পারে না, বিশেষ করে যেখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র জঙ্গিদের মদত দিয়ে থাকে।

২০১৮ সালে রুশ গোয়েন্দারা যখন ইংল্যান্ডের শান্ত শহর সলিসবারিতে গুপ্তচর সার্গেই স্ক্রিপালকে হত্যা করতে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার তখন ২৩জন রুশ কূটনীতিককে ইংল্যান্ড থেকে বহিস্কৃত করেছিল। শুধু তাই নয়, ইংরেজ সরকারের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র সহ ২০টি দেশ একশো জনেরও বেশি রুশ কূটনীতিককে তাদের দেশ থেকে বহিস্কৃত করে। এই কূটনীতিকদের অনেকেই রুশ গুপ্তচর ছিলেন।

দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসও তো অনেকটা একই রকমের, যেখান থেকে আইসিএআই গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়ে থাকে। উপত্যকায় যারা ঢিল ছোড়ে তাদের পারিশ্রমিক ও নিজেদের পাওনা টাকা নিতে হুরিয়ত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রায়শই এখানে অতিথি হয়ে আসে। এখনও অবধি ভারতীয় করদাতাদের টাকাতেই এই দূতাবাসের নিরাপত্তা দেওয়া হত। যদিও পুলওয়ামা হামলার পর সেই ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় সাংবাদিক, প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন গোয়েন্দা আধিকারিক ও সমাজকর্মীদের এই দূতাবাসে প্রায়শই প্রবেশ করতে দেখা যেত।

বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়া পাকিস্তানকে মোট চারটি ক্ষেত্রে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে - সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও গুপ্তহানার মাধ্যমে।

কী ভাবে সম্ভব তা একবার দেখে নেওয়া যাক।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক হানার ব্যাপারে প্রথাগত ভাবে সতর্ক থাকে ভারত। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর শ্রীনগর হাইওয়েবরাবর উপত্যকা অঞ্চলে পাকিস্তানের আফ্রিদি জনগোষ্ঠীর একটি দল আকস্মিক ঢুকে পড়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাদের সীমান্তের ওপারে ফেরত পাঠাতে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে যখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিচ্ছিল তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্যাম মানেকশ'র নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পাঠান। এরপর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ যখন ভারত আক্রমণ করে তখন বাজপেয়ী সরকার সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পাল্টা যুদ্ধ শুরু করে।

এই প্রতিটি যুদ্ধেই ভারত সফল হয়েছে।

body1_021919015430.jpg১৯৭১এর যুদ্ধে শক্তি প্ৰয়োগ করে পাকিস্তানের মনোভাব পরিবর্তন করেছিল ভারত (সৌজন্য: উইকিম্যাপিয়া কমন্স)

কোথাও কোনও পাল্টা-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরঞ্চ ১৯৭১এর বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী ১৮ বছর ধরে দু'দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। অর্থাৎ জোর করে শক্তি প্রদর্শন করে ভারত প্রতিবেশীর মানসিকতার পরিবর্তন করতে পেরেছিল।

তবে তা বেশিদিন টেকেনি। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জিহাদিরা কাশ্মীরে প্রবেশ করতে শুরু করে দিল। এর এক দশক বাদে, ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে হারের পর পাকিস্তান এই অসম যুদ্ধনীতি থেকে সরে আসল। ততদিনে চার চারটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান। দেশের অর্থনীতি আরও একটি যুদ্ধ হারের চাপ সামলাতে পারবে না।

এর পরেই সস্তার প্রক্সি সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার করে ভারতকে রক্তাক্ত করা শুরু করে দিল পাকিস্তান।

কার্গিল পরবর্তী সময়ে একের পর এক জঙ্গি হামলা দেখা গেল - সংসদ ভবনে, মুম্বাইয়ের ২৬/১১, গুরদাসপুর, পাঠানকোট, উরি এবং এবার পুলওয়ামা। ভারতও সরাসরি সামরিক যুদ্ধের ইচ্ছে ত্যাগ করে ফেলল।

মুম্বাইয়ের ২৬/১১ সন্ত্রাস হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশি সহ ১৬৬জন লোক নিহত হয়েছিল। সেই সময়েই এই মানসিকতা বদলের আদর্শ সময়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পাকিস্তান আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে ফেলেন। পরবর্তী ছ'বছর ধরে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক চাপানউতোর চলতে থাকল এবং অবশেষে ২০১৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ক্ষমতা হারাল। তবে পরের পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদীর সরকারও কাজের কাজ কিছুই করেনি।

পরমাণু সংক্রান্ত মিথ্যে

পাকিস্তান প্রায়শই পরমাণু শক্তির হুমকি দিয়ে থাকে যাতে ভারত সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকে - এই হুমকির পুরোটাই মিথ্যে।

২০১৫ সালে ডেইলিও-তেই আমি লিখেছিলাম: "ইসলামাবাদ পরমাণু অস্ত্র কখনই ব্যবহার করতে পারবে না। কারণটা খুবই সহজ সরল। ভারত যদি পাল্টা পরমাণু হামলা চালায় তাহলে পাকিস্তান চুরমার হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রও বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। রুশ ও ব্রিটিশরাও বিষয়টি জানে। এবং, অবশ্যই পাকিস্তান নিজেও বিষয়টি জানে।"

পাকিস্তান তাই জিহাদিদের হাতিয়ার করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়। ভারতের উচিত পাল্টা সামরিক আক্রমণ করে পাকিস্তানকে জবাব দেওয়া। এই আক্রমণের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এ রকম একটা ধারণা রয়েছে - যা একেবারেই ভ্রান্ত। কার্গিল যুদ্ধও একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। যদিও ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান দু'দেশের কাছেই পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার মজুত ছিল।

সামরিক আক্রমণ ছাড়াও আরও তিনটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে ভারত।

body2_021919015515.jpgএবার পাল্টা দেওয়ার সময়ে এসেছে [ছবি: ডেইলিও]

প্রথমত, ভারতের অর্থনৈতিক স্ট্র্যাটেজিস্টদের ফিনান্সিয়াল টাস্ক ফোর্সকে উৎসাহ দেওয়া উচিত যাতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে চলা বৈঠকে পাকিস্তানের নাম ব্ল্যাকলিস্ট করে দেওয়া হয়। ব্ল্যাকলিস্ট করতে পারলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল চাপে পড়ে যাবে পাকিস্তান।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে ফেলতে হবে ভারতকে।

তৃতীয়ত, স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করে বালোচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে ক্ষুদ্ধ পাস্তুনদের হাতিয়ার করে গোপন অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে ভারতকে।

পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এখনও অবধি বেশ ভীত দেখাচ্ছে ভারতকে। এক গুচ্ছ ভারতীয় সমাজসেবী, ট্র্যাক-২ বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সমালোচনায় মুখর হয়ে পড়েন। এই বিরোধিতা বন্ধ করতে হবে।

পুলওয়ামার পর ভারতের এই 'শান্তি চাই' মানসিকতা বন্ধ করতে হবে। জঙ্গিদের মদত দেওয়ার জন্য উচিত শিক্ষা দিতে হবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে। শুধু তা করতে পারলেই পাকিস্তানের অপরাধপ্রবণ মানসিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MINHAZ MERCHANT MINHAZ MERCHANT @minhazmerchant

Biographer of Rajiv Gandhi and Aditya Birla. Ex-TOI & India Today. Media group chairman and editor. Author: The New Clash of Civilizations

Comment