ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে: ইমরান খানকে খোলা চিঠি লিখলেন রাজদীপ সারদেশাই

শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জঙ্গিহামলার জন্য দোষ দিয়ে লাভ নেই, দায় আপনারও কারণ সরকারটা আপনার

 |  6-minute read |   20-02-2019
  • Total Shares

শ্রদ্ধেয় ইমরান ভাই,

ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে আমার এই পত্রাঘাত। পুলওয়ামার জঙ্গিহানায় ৪০ জন সিআরপিফ জওয়ান নিহত হয়েছেন - আর পাঁচজন ভারতীয়র মতো আমিও এই ঘটনায় যারপরনাই ক্রুদ্ধ। এই ঘটনা আমাদের রক্তাত করে তুলেছে। এর বদলা নেওয়ার জন্য আমরা মুখিয়ে রয়েছি।

পুলওয়ামার জঙ্গিহানার পিছনে যে পাকিস্তানের মদত রয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। আত্মঘাতী হামলাকারী কাশ্মীরি হতেই পারেন, কিন্তু তাঁকে চালিত করা হয়েছিল পাকিস্তানে অবস্থিত জৈশের সদরদপ্তর থেকে। সেখান থেকেই তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাঁকে অস্ত্রশস্ত্র সরবারহ করা হয়েছিল এবং তাঁর পথ বাতলে দেওয়া হয়েছিল।

কোনও রাষ্ট্রের হয়ে নয়, জৈশরা স্বাধীনভাবে কাজ করেছিল - এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই ধারণা নিতান্তই ভ্রান্ত। জৈশ নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক সুদীর্ঘ কাল থেকেই নথিভুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরেও এই সম্পর্কের কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। একমাত্র, আপনার প্রিয় বন্ধু চিন এই তথ্যটি মানতে চায় না।

body_022019020638.jpgপুলওয়ামা জঙ্গিহামলার চক্রান্তকারী করা এবং তারা এখন কোথায় লুকিয়ে রয়েছে তা সকলেরই জানা [ছবি: রয়টার্স]

দোষটা একমাত্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উপর দেওয়াটা ঠিক হবে না। আপনার দেশের প্রশাসনিক শাসকরাও তো একই পথের পথিক। পাকিস্তান সরকার আপনার সরকার। আপনি পাকিস্তানের সর্বেসর্বা, দেশের প্রধানমন্ত্রী। আপনি দেশের 'নির্বাচিত' মুখ্য কার্যকর্তা।

পাকিস্তানে যা ঘটে তা আপনার চোখের সামনেই ঘটে। আমরা জানি, আপনার দেশে সর্বদাই দেশের সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন - যা গত সত্তর বছর ধরেই হয়ে আসছে। কিন্তু তাই বলে আপনি আপনার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কার্তারপুরের দরজা খুলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে আপনি যদি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, তাহলে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কাশ্মীর জুড়ে যে জঙ্গিহানা ঘটেই চলেছে সেই ব্যর্থতার দায়ও আপনাকে স্বীকার করে নিতেই হবে।

আর, এখন থেকেই আমাদের বিষণ্ণতার সূত্রপাত।

একজন ক্রিকেটার, অধিনায়ক, মানবপ্রেমী ও একজন সত্যিকারের নেতা হিসেবে আমি সর্বদাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি। ক্রিকেটার হিসেবে আপনি একজন অসাধারণ অল-রাউন্ডার ছিলেন, একজন সত্যিকারের নেতা ছিলেন যিনি একদল প্রতিভাবান অথচ ঝগড়ুটে ক্রিকেটারদেড় অনুপ্রাণিত করে বিশ্বজয় করতে পারতেন।

আপনার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং কিংবা অনবদ্য ফাস্ট বোলিংয়ের আমরা বারংবার অভিভূত হয়েছি, আপনার দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্যে আমরা বারংবার আকৃষ্ট হয়েছি এবং একাধিকবার চোট সরিয়ে প্রত্যাবর্তনের পরে আপনি যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতেন তা দেখে আমরা বারংবার অনুপ্রাণিত হয়েছি। আর, ১৯৯২ সালে আপনি যখন বিশ্বকাপ জয় করলেন তখন আপনার সেই বিস্ময়কর সাফল্যের সাক্ষী থাকতে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

body1_022019020707.jpgমৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে যে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে তা আপনার আচরণেই স্পষ্ঠ [ছবি: রয়টার্স]

এই উপমহাদেশের এক প্রজন্মের ক্রিকেটভক্তদের কাছে আপনি রোল-মডেল ছিলেন। ক্রিকেট পরবর্তী জীবনে আপনি যখন ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য হাসপাতাল গড়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন তখন আপনাকে দেখে আমি আরও বেশি করে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই অঞ্চলের আর কোনও ক্রীড়াবিদ আপনার মতো নিজের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ায় চেষ্টা করেনি। আপনি সত্যিই আক্ষরিক অর্থে 'নয়া পাকিস্তান' গড়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন।

নব্বইয়ের দশকের শেষে আপনার রাজনীতিতে প্রবেশ করাটা আমি প্রথমে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ক্রমাগত দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আপনি আমার হৃদয় জয় করে নিলেন।

আমাকে যখন বলা হয়েছিল যে রাজনীতিবিদ ইমরান খান ইসলামিক মৌল্যবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন আমি তা বিশ্বাস করতে চাইনি। আমার স্পষ্ঠ মনে পড়ে দিল্লির এক অনুষ্ঠানে আপনাকে তালিবান খান বলে সম্বোধন করা হয়েছিল বলে আপনি ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন। আপনার সেই ক্রোধ যথাযথ ছিল। ঠিক যেমন আপনি একবার সঠিক বিচার করে বলেছিলেন, যুক্তরাস্ট্র যেভাবে আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে তা শান্তিরক্ষার জন্য ক্ষতিকারক।

আমি বুঝতে পারছি যে রাজনীতিতে সব ধরণের সমঝোতা মেনে নিতে হয়। কিন্তু এর পরেও আমি আপনাকে সন্দেহের উর্দ্ধে রাখতে চেয়েছিলাম।

গত বছর আপনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবর শুনে আমি যারপরনাই অভিভূত হয়েছিলাম।

হাজার হোক আপনিই প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হলেন। এই মুহূর্তটা সত্যিই ঐতিহাসিক। খবর প্রকাশিত হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রথম পছন্দ আপনি এবং আপনার জয় সুনিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং করেছে। এই খবরে আমি প্রথমে কিছুটা ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু, পরমুহূর্তে আমার মনে হয়েছে আপনি অন্তত কারোর হাতের পুতুল হতে চাইবেন না। আপনার যা ব্যক্তিত্ব তাতে কেউই বেশি সময় ধরে আপনার উপর কতৃত্ব করতে পারবেন না।

body2_022019020814.jpgকর্তারপুরে আপনার ভাষণ আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল [ছবি: রয়টার্স]

আপনার জমানায় এই বিরক্তিকর ভারত-পাক সম্পর্কের প্রভূত উন্নতি ঘটবে বলে আমি আশাবাদী ছিলাম।

আর কোনও পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী এত বার ভারতে আসেননি। আপনার মতো গন্যমান্য ভারতীয় বন্ধুর সংখ্যা আর কোনও পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর নেই। তাই আমি ভেবেছিলাম, দু'দেশের মধ্যে বহু যুগের যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ রয়েছে আপনার জমানায় তার নিরসন ঘটবে। এর পর যখন আপনি কার্তারপুরের দরজা খুলে দিলেন তখন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আপনার দেশের সেনাবাহিনী আপনাকে যথেষ্ট কর্ম স্বাধীনতা দিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমিও কার্তারপুর গিয়েছিলাম কারণ আমি ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলাম। শিখ তীর্থক্ষেত্রে আপনি আপনার বক্তৃতায় দুটি দেশকে বিষণ্ণ ইতিহাস ভুলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলার আহ্বান জানালেন। আপনার সেই বক্তৃতা সেদিন আমার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল। এর পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে আপনি জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানে জেলে বন্দি এক তরুণ ভারতীয়র বিষয়টি আপনি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন। সেদিনও আপনি আমার হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলেন।

আপনি সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন, সঠিক কতগুলো বলছিলেন এবং সঠিক বোতামগুলোই টিপছিলেন। এই ইমরান খানকেই তো আমি চিনি, আমি শ্রদ্ধা করি। যিনি সীমানার ওপারেও ইতিহাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকেন।

এর পরেই পুলওয়ামাতে জঙ্গিহামলার ঘটনা ঘটল।

হটাৎ করেই আপনি মৌনব্রত পালন শুরু করে দিলেন এবং ঘটনাটির জন্য কোনও রকম নিন্দা বা দুঃখ প্রকাশ করলেন না। এটা সত্যি যে পুলওয়ামার জঙ্গিহানার চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আপনি কোনও রকম ব্যবস্থা নিতেই পারবেন। মাসুদ আজহার যে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

body3_022019020914.jpgক্ষমতা থাকলে মাসুদ আজহারকে ভারতের হাতে তুলে দিন [ছবি: রয়টার্স]

ক্রিকেট মাঠে আপনি কোনও দিনও পিছু হাঁটেননি। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে আপনি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন যারা আপনার সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আপনি যদি আজহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারেন তাহলে টিয়াপাখির মতো সেখান বুলি আওড়াবেন - কাশ্মীরের জমি বিতর্কিত, সেখানকার সন্ত্রাসবাধী সমস্যা একান্তই আঞ্চলিক এবং জৈশের মতো দলগুলো আদতে স্বাধীনতা সংগ্রামী।

আর, যারা ভারতে সন্ত্রাসবাদ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আপনি যদি কোনও ব্যবস্থাই না নিতে পারেন তাহলে ভারতের বন্ধুত্বের কিংবা ভারতের দেওয়া আতিথেয়তার কী মূল্য আপনি দিলেন?

ইমরান ভাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। ক্রিকেটার হিসেবে আপনি নিরপেক্ষ আম্পায়ারের কথা বলেছিলেন। রাজনীতির ময়দানেও আপনাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে যারা বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিতে চাইছে।

মাসুদ আজহারকে ভারতের হাতে তুলে দিন। সীমান্ত বরাবর জঙ্গিশিবিরগুলো বন্ধ করে দিন। আর, সেনাবাহিনীকে বলুন তারা যেন ভারতের বিরুদ্ধে 'হাজার বছরের যুদ্ধ' অবিলম্বে বন্ধ করে।

আমি জানি যে এই কাজগুলো করতে পারলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার মেয়াদ অচিরেই ফুরিয়ে যাবে। আপনিই আপনার পছন্দটা বেছে নিন। এক হয়, একটি বড় কর্মের জন্য নিজের পদ হারান। নয়ত, এ দেশে আপনার যে সুনাম রয়েছে তা খোয়ান।

পরিশেষে বলতে চাই, ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে আমার এই পত্রাঘাত। ক্ষোভ হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাবে। কিন্তু দুঃখটা যে চিরজীবনের জন্য রয়ে যাবে।

ভালো থাকবেন,রাজদীপ সারদেশাই

পুনশ্চ: গত সপ্তাহের শেষে শিব সেনার হুমকির মুখে পড়ে ক্রিকেট ক্লাব ও ইন্ডিয়া ক্লাবের গ্যালারির দেওয়াল থেকে আপনার ছবি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক ক্রিকেট রোমান্টিক হিসেবে আমি এই সিদ্ধান্তে যারপরনাই দুঃখিত কারণ ক্রীড়া জগৎকে রাজনীতির বাইরে রাখাটা শ্রেয় বলেই আমি মনে করি।

কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি যে এ ক্ষেত্রে আমি নিতান্তই সংখ্যালঘু এবং আপনার বিরুদ্ধে আওয়াজটা কথা থেকে আসছে তা আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।

একজন ক্রিকেট কিংবদন্তি হিসেবে আপনাকে নিয়ে গর্ব করা উচিত; কিন্তু পাকিস্তান ভারতকে রক্তাত করে চলেছে আর সেই পাকিস্তানের শাসক হিসেবে আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করা যাচ্ছে না।

(প্রবন্ধটি প্রথমে লেখকের ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল)

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RAJDEEP SARDESAI RAJDEEP SARDESAI @sardesairajdeep

Journalist, author: 2014: The Election That Changed India. When not chained to the news, watch sport, read, write, sleep and enjoy family holidays.

Comment