হিন্দু পাকিস্তান মন্তব্য করে বিজেপির হাতে কী ভাবে অস্ত্র তুলে দিলেন শশী থারুর

সংবিধান বদল করা আসলে কংগ্রেসেরই স্বভাব, সংবিধান রদ করাও

 |  5-minute read |   17-07-2018
  • Total Shares

বিজেপির হাতে কি ২০১৯ সালের প্রচারের অস্ত্র তুলে দিলেন তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর? ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদীকে চা-ওয়ালা বলে বিদ্রুপ করে মণিশঙ্কর আইয়ারও এই একই ধরনের কাজ করেছিলেন। 

সাধারণ নির্বাচনের আর ন’মাস বাকি, সাধারণ লোকের স্মৃতিশক্তিও বেশ কমই। তবে থারুরের এই মন্তব্যে রাজনৈতিক ক্ষত বজগে উঠতে পারে।

শশী থারুর কেন তাঁর বক্তৃতায় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে কথাটি বলেছেন: “গণতান্ত্রিক সংবিধানকে আমরা যে ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকি, যদি তারা (বিজেপি) আবার লোকসভা ভোটে জয়ী হয় সেই সংবিধান আর থাকবে না, ভারতের সংবিধানের যে সব অংশ তাদের পছন্দ নয় তা তারা ছিঁড়ে ফেলে নতুন একটা সংবিধান রচনা করবে। হিন্দুরাষ্ট্রের নীতি মেনে তৈরি নতুন সেই সংবিধান রক্ষিত হবে মন্দিরের মধ্যে, সেই সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হবে সংখ্যালঘুদের সমানাধিকার, তৈরি হবে হিন্দু পাকিস্তান তবে এর জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করেননি মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ ও অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।”

হিন্দুরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আমি এখানে প্রায়শই ভারত রাষ্ট্রের কথা লিখে থাকি যেখানে হিন্দুত্বের কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না। হিন্দু ধর্মের প্রতি আমার আনুগত্য সেই সব লেখাতেই ফুটে উঠেছে। ভারতরাষ্ট্র হল এমন এক রাষ্ট্র যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু তবে সংখ্যালঘুরাও তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের ক্ষমতায়ন হবে, দমিয়ে রাখা হবে না, কংগ্রেস যা দশকের পর দশক ধরে করে এসেছে। সংখ্যালঘুরাও ভারতীয় হবে, তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় হবে গৌণ ব্যাপার, হিন্দুদের ক্ষেত্রেও তাই।

আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র নির্মাণে প্রত্যেকের সচেষ্ট হওয়া উচিৎ, ধর্মীয় পরিচয় হবে এখানে গৌণ। অ-হিন্দু অর্থাৎ মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি, ইহুদি, শিখ—সকলের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য হবে।

তা হলে থারুরের হিন্দু পাকিস্তান মন্তব্য কেন তথ্যগত ভাবে ভুল ও অসময়ে করা বলে মনে হচ্ছে?

প্রথমত, থারুর যেমন সহজ ভাবে তাঁর মন্তব্য করে দিয়েছেন সে ভাবে পাকিস্তান শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের বিভেদই করে না, তাদের হত্যা করে। আহমেদিয়াদের গুলি করে মারা হয়, আইনে সেই সংস্থানও রয়েছে। ভারতে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোটামুটি দুই দশকে ১০ বছরে বিজেপির শাসন চলার পরে সংখ্যালঘুরা শুধু অধিকারই অর্জন করেনি, তারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।

body_071718041025.jpg

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানে পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। উল্টোদিকে আমাদের দেশে দিনরাত সেনাবাহিনীকে নানা মাপের রাজনীতিক, বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে যুক্ত কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নিন্দামন্দ সহ্য করতে হয়।

তৃতীয়ত, ২০১৯ সালে বিজেপি জিতলে সংবিধান বদল করবে বলে থারুর যে মন্তব্য করেছেন, সেটি আসলে কংগ্রেসেরই বদ অভ্যাস। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শুধুমাত্র সংবিধানই বদল করেননি, তিনি ১৯৭৫ সালে তা রদ পর্যন্ত করে দেন। বিজেপি একটু বেশি মাত্রাতেই ধর্মপ্রাণ (এটা ভালো নয়) তবে সংবিধান বদলে ফেলা তাদের মূল বিবেচ্য নয়।

হিন্দু পাকিস্তান কথাটি বেশ আপত্তিকর। থারুর সে কথা জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন এ কথা বলেলন? তিনি আসলে একটা ব্যাপারে ভুল বুঝেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন এটা তাঁর দলের পক্ষে যাবে, যারা আরএসএস এবং হিন্দুত্বের নিন্দা করে। তবে দেরিতে হলেও রাহুল বুঝতে পেরেছেন যে বেশি মাত্রায় হিন্দুত্বের বিরোধিতা করলে ভোটে তার ফল ভুগতে হবে। তবে থারুর সেই লেখন পড়ে উঠতে পারেননি।

কংগ্রেস সভাপতি ধীরে ধীরে খানিকটা স্কিজোফ্রেনিক হয়ে পড়েছেন। মাঝে মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেন না যে কংগ্রেস এমন একটা দল হবে যা মুসলমান খ্রিস্টানদের (দেশে মিলিত ভাবে যাদের ১৮ শতাংশ ভোট রয়েছে) মন জুগিয়ে চলবে নাকি একটু হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকবে, যে কারণে তিনি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেও বেড়িয়েছেন। থারুরের হিন্দু-পাক মন্তব্য যখন ভাইরাল হয়ে গেল তখন রাহুল তাঁর দলকে এই মন্তব্য থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিলেন।

দলের সদস্যরা মাঝেমধ্যেই দলীয় গণ্ডী পার করে করে ফেলে, আর দ্বিতত্ত্ববাদী কংগ্রেস এই ব্যাপারের সঙ্গে অভ্যস্ত। কখনও কখনও তারা এ কথা বলে: “সংখ্যালঘুদের যথেষ্ট সমর্থন থাকলেও আমরা সকলকে নিয়ে চলা দল এবং আমরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হতাশ করব না। হিন্দুত্ব-বিরোধী খোঁচা সংখ্যালঘুদের সন্তুষ্ট করে ঠিকই, তবে বেশিমাত্রায় এ কাজ কর না। আমাদের হিন্দু ভোটও দরকার।”

এই কারণেই কংগ্রেস নিয়মিত ভাবে দূরত্ব বজায় রাখে মণিশঙ্কর আইয়ার (পাকিস্তান নিয়ে পরিহাসের জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড), সঞ্জয় নিরুপম ও সন্দীপ দীক্ষিত (ভারতীয় সেনা নিয়ে নিয়মিত ভাবে বিরূপ মন্তব্য করা) এবং এখন শশী থারুর, যিনি অনেকটা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো চরম বেফাঁস মন্তব্য করে বসেছেন।

এক দশকের বেশি সময় ধরে আমার প্রকাশনায় থারুরের ১২০টির বেশি রচনা সম্পাদনার করার জেরে বলতে পারি যে তিনি যা বলতে চান সেটাই বলে থাকেন। টানা ২৯ বছর আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের আমলা থাকার দরুণ তাঁর বাচন সেই ভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছে, ভারতের রাজনীতির টানাপোড়েনের মধ্যেও তাঁকে সুচারু ভাবে কর্মসম্পাদন করতে হত। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপুঞ্জে থাকার সুবাদে নির্দেশ মেনে চলা তাঁর অভ্যাস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানের সঙ্গে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং এমন একটা সময়ে যখন খাদ্যের পরিবর্তে তেল ইস্যুতে মারাত্মক ভাবে জলঘোলা হচ্ছিল।২০০৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে অবসর গ্রহণের পরে ২০০৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে একই ভাবে তিনি তাঁর নতুন ‘বস’-এর ক্ষেত্রেও একই মনোভাব দেখিয়েছেন।

এ বছরের শেষ দিতে হতে চলা বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ভোট ও ২০১৯ সালে নির্ধারিত লোকসভা ভোটের আগে রাহুল গান্ধী কি তাঁর দলকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারবেন?  ধর্ম নিয়ে তিনি অনেকটাই নরম পন্থা নিয়েছেন, গুজরাট ও কর্নাটক জুড়ে তিনি বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কংগ্রেসের সংখ্যালঘু-প্রীতি থেকে নরম অবস্থান গ্রহণ করেছেন। আধুনিক হিন্দুরাই তাঁর লক্ষ্য।

জাতপাত, অঞ্চল ও ভাষাগত ভাবে হিন্দুরা বিভক্ত। তাই বিজেপির কাজ বেশ কঠিন। রাহুলও দুর্দান্ত ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে দলিত তাস খেলে দিয়েছেন। ভারতের ভোটারদের ১৭ শতাংশ হলেন দলিত। তাঁরা মুসলমানদের মতো সকলে মিলে এক দিকে ভোট দেন না। অনেকেই মায়াবচীর মতো আঞ্চলিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভোটের সময়ে সমঝোতা করছেন। রাহুল চাইছেন দলিত ও বিজেপির মধ্যে দূরত্ব বাড়ুক। কংগ্রেস মনে করছে যে মুসলমান, দলিত ও আধুনিক হিন্দুদের সঙ্গে পেলে ২০১৪ সালের ১৯ শতাংশের তুলনায় তারা ভোট বাড়াতে পারবে।

১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের ভোটের হার ওঠানামা করেছে ২৮ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশের মধ্যে। ১৯৯৯ সালে তারা পেয়েছিল ২৫.৮২ শতাংশ ভোট, ১৯৯৯ সালে পেয়েছিল ২৮.৩০ শতাংশ ভোট, ২০০৪ সালে (যে বার তারা ক্ষমতায় ফিরল) পেয়েছিল মাত্র ২৮.৫৫ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমে ১৯ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের আসনসংখ্যা ২০৬ থেকে কমে হয়ে যায় ৪৪।

রাহুল মনে করছেন ২০১৯ সালের ভোটে কংগ্রেস তার আসনসংখ্যা ২০১৪ সালের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ করে ফেলবে। মণিশঙ্কর আইয়ারের চা-ওয়ালা মন্তব্যের মন্তব্যের মতো থারুরের হিন্দু-পাক তত্ত্ব কংগ্রেসের এই উত্থানের স্বপ্নকে দমিয়ে দিতে পারে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MINHAZ MERCHANT MINHAZ MERCHANT @minhazmerchant

Biographer of Rajiv Gandhi and Aditya Birla. Ex-TOI & India Today. Media group chairman and editor. Author: The New Clash of Civilizations

Comment