কেন্দ্রে ক্ষমতা বদল হলে 'স্ট্যাচু অফ ইউনিটি'র উপরও কি হাতুড়ির ঘা পড়বে?
মূর্তি ভাঙা গড়ার রেওয়াজ বেশ পুরোনো, তালিবান ভেঙেছিল বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি
- Total Shares
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার উঁচু মূর্তি তৈরি করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুধু তো মূর্তির উচ্চতা নয়, মূর্তির সঙ্গে সরোবর হোটেল, মিউজিয়াম, বাগান, ও কনভেনশন সেন্টার, সবকিছু মিলিয়ে চিনে প্রিয়ং টেম্পল বুদ্ধ, জাপানে উসিকু দৈবুতসু ইবারকি, আমেরিকায় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, রাশিয়া মাদার ল্যান্ড কল ও ব্রাজিলে ক্রাইস্ট দ্য রিদিমারের মতো বিখ্যাত মূর্তিকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত।
ভারতের মতো গরিবের দেশে এত টাকা খরচ করে এই মূর্তি তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কে ঘি ঢেলেছেন ব্রিটেনের কয়েকজন সাংসদ। তাঁদের বক্তব্য, যে দেশ মূর্তি তৈরির পিছনে এত অর্থ ঢালতে পারে তাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন কী। ব্রিটিশ আয়করদাতাদের অর্থ এ ভাবে নষ্ট করা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তবে এই লেখায় আমি সে প্রসঙ্গে যেতে চাই না।
সুদূর অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে মূর্তি গড়া ও ভাঙা নিয়ে যে সাতকাহন রয়েছে আমি তার মধ্যে থাকতে চাই।
ঐক্যের প্রতিমূর্তি গড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
অভীষ্টপূরণে মহাভারতে দ্রোণাচার্যের মূর্তি গড়ে শিষ্য একলব্যের তীরন্দাজির শিক্ষার কথা আমরা জানি। রামচন্দ্রের পদস্পর্শে পাষাণ হয়ে যাওয়ায় অহল্যার প্রাণ ফিরে পাওয়ার গল্পও আমাদের মহাকাব্যে রয়েছে। পরবর্তীকালে অনেক পণ্ডিত তাঁদের বিদগ্ধ আলোচনায় এ সব কাহিনির পিছনে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শক্তির প্রান্তিক জনের সম্পর্কের যে রাজনীতি রয়েছে তা তুলে ধরেছেন।
পৌরাণিক আখ্যানের পরতে রাজনীতির এই ঝোঁকের কথা ছেড়ে দিলেও মূর্তি গড়া ও ভাঙা নিয়ে সরাসরি রাজনীতির যোগের উদাহরণও কিছু কম নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি -- যা আমেরিক্যান ডিক্লারেশন অফ ইন্ডেপেনডেন্সের স্পিরিটের প্রতীক। এই মূর্তির ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, "Lady liberties significance grew as an inspiration to immigrants who sailed past her on their way to America."
এই ইমিগ্রান্ট শব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন খুব তোলপাড় চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর অভিবাসন নীতি নিয়ে একের পর এক কড়া পদক্ষেপ করছেন। সম্প্রতি সেই দেশের এক নাগরিকের লেখায় পড়লাম, মার্কিন মুলুকে এখন ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির প্রসঙ্গে স্ট্যাচু অফ লিবার্টিমাকে নাকি অনেকে বলছেন, "Where liberty is statue."
বামিয়ানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করেছিল তালিবান [ছবি: রয়টার্স]
বিশ্বে এখন বিভিন্ন দেশে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ অনেক বেড়েছে। এই যোগসূত্রেই 'ইসলামোফোবিয়া' কথাটা চালু হয়েছে। তালিবান, আইএস ও আল কায়েদার উগ্র কার্যকলাপের অভিঘাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলো ইসলামোফোবিয়াকে হাতিয়ার করেছে। মুসলিম বিদ্বেষ বোঝাতেই ইসলামোফোবিয়া শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে তালিবান এই বিষয়ে কারুর চেয়ে কম যায় না। ২০০১ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ তালিব নেতা মোল্লা মহম্মদ ওমর আফগানিস্তানে অ-ইসলামিক মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এর পরে ষষ্ঠ শতাব্দীতে মধ্য আফগানিস্তানের বামিয়ানে ১৭০ফুট ও ১১৫ ফুট উঁচু দু'টি বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে দেয় তালিবান।
মূর্তি ভাঙা গড়ায় রাজনীতির সরাসরি যোগ নিয়ে এবার একটু দেশের দিকে ফেরা যাক।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মূর্তির ভাঙার প্রচুর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে গত শতকের ছ'য়-সাতের দশকে। নকশালপন্থী নেতা চারু মজুমদার সেই সময়ে বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথদের বুর্জোয়া সংস্কৃর্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাই এঁদের মূর্তি ভেঙে বিল্পবী সংস্কৃতি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় এই সব মনীষীর মূর্তি ভেঙে ছিলেন নকশালপন্থীরা। মুক্তি ভাঙার রাজনীতি নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল রাজ্যে।
ত্রিপুরায় পালা বদলের পর লেনিনের মূর্তি ভাঙল বিজেপি [ছবি: পিটিআই]
পালা বদলের পরে রাজনৈতিক কারণে মূর্তি ভাঙা উদাহরণ রাশিয়া ও ইউরোপের বহু দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে। তবে সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণটি রয়েছে আমাদের দেশে।
কিছুদিন আগেই দীর্ঘদিনের বামশাসনকে হটিয়ে ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। আমরা দেখলাম ক্ষমতা দখলের পরেই আগরতলায় ভাঙা হল লেনিন মূর্তি। রীতিমতো পুরসভা থেকে বুলডোজার নিয়ে এসে সেই মূর্তি ভাঙার ছবি আমরা দেখেছি। অদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রে ক্ষমতা বদল হলে স্ট্যাচু অফ ইউনিটির উপর হাতুড়ি পড়বে কিনা আমি তা জানি না।
তবে একটা কথা বলা যায়, জীবিতকালে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর সাহসিকতার জন্যে যেমন 'লৌহ মানব' হিসেবে পরিচিত ছিলেন তেমনই তাঁর মূর্তি তৈরিতেও টন টন লোহা ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এই মূর্তি ভাঙতে হলে যে পরিমান পরিশ্রম করতে হবে তাতে বলা যায় ভাঙার কাজে এগোবার আগে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে।
এইটুকুই আমদের কাছে আশ্বাস হয়ে থাকুক।