আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রকৃত অবস্থান কী

আঞ্চলিক দলগুলিকে উচ্ছৃঙ্খল বলে ইস্তাহারে কটাক্ষ করেছিল কংগ্রেস

 |  4-minute read |   29-01-2019
  • Total Shares

কখনও ছিল তৃতীয় ফ্রন্ট, কখনও ইউনাইটেড ফ্রন্ট, কখনও আবার ফেডেরাল ফ্রন্ট। নাম বদলে ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে সেটিই হয়েছে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া। আঞ্চলিক দলগুলির মঞ্চে সর্বভারতীয় দল হিসাবে উপস্থিত ছিল কংগ্রেসও। সেই মঞ্চে ছিলেন বর্তমানে জনতা দল (সেকুলার)-এর সভাপতি তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়া। কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করায় সিপিএমের সমর্থনে তৈরি ১৩ দলের সরকারের পতন ঘটে, পরপর দু’বার। প্রথমে দেবগৌড়া এবং তার পরে ইন্দরকুমার গুজরাল সরকারের।

কেন সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল কংগ্রেস? রাজনৈতিক কারণ ছেড়ে একবার তাত্ত্বিক কারণটি দেখা যাক।

দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে ১৯৯৮ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে আঞ্চলিক দলগুলো সম্বন্ধে কংগ্রেস লিখেছিল: ১৪টি আঞ্চলিক ও রাজ্যস্তরের উচ্ছৃঙ্খল দলের এই জোটের আদর্শগত কোনও সাজুয্য নেই।

সংযুক্ত ফ্রন্ট নতুন এক তত্ত্ব খাড়া করছে। তারা মনে করছে কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসনের দিন শেষ হয়ে গেছে এবং আমরা জোট সরকারের যুগে প্রবেশ করেছি।

এখনই এ কথা বলার সময় আসেনি যে কেবলমাত্র আঞ্চলিক দলগুলির জোট সরকারই প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিফলিত করতে পারে।

কংগ্রেস মনে করে এই ভাবনা অন্তঃসারশূন্য, ভিত্তিহীন এবং ভয়ঙ্কর।

sh1_1900_012919054458.jpg ইউনাইটেড ফ্রন্টই ২০১৯ সালে ইউনাইডেট ইন্ডিয়া: ১৯৯৮ সালে তাদের উচ্ছৃঙ্খল বলে বর্ণনা করা হয়েছিল কংগ্রেসের ইস্তাহারে। (ছবি: সুবীর হালদার)

১৯৯৬ সালে সরকার গড়ার ১৩ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গড়ে আঞ্চলিক দলগুলি। বিজেপিকে হঠাতেই তারা বিকল্প সরকারকে সেই দিন সমর্থন করেছিল। ১৯৯৯ সালে যখন আঞ্চলিক দলগুলো এক মঞ্চে আসছিল সরকার গড়ার জন্য, তখনও কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া তাদের সরকার গড়ার ক্ষমতা ছিল না। সরকার তৈরিও হয়নি।

এখন কি আঞ্চলিক দলগুলো সম্বন্ধে কংগ্রেসের ভাবনা বদলে গেছে? নাকি তাদের বিশ্বাসে কোনও বদল না হলেও স্রেফ ক্ষমতার লোভে তারা উঠেছে নাম বদলে ফেলা সেই ইউনাইটেড ফ্রন্টের মঞ্চে? ফেরা যাক বিশ বছর আগে।

সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে বেশিরভাগ লড়াই হচ্ছে সভামঞ্চ থেকে। সংসদে ক্ষুরধার বক্তৃতা সাম্প্রতিক কালে শোনা যায়নি। তবে দুই দশক আগে ঠিক এমন ছিল না। সংসদে তখন বাজপেয়ী।

  • বাজপেয়ী ভালো, তাঁর দল ভালো নয়... আপনি সরে যান, পাঁচ মিনিটে সরকার গড়ে ফেলব...

কেন্দ্রে ১৩ দিনের মাথায় একবার শক্তি পরীক্ষা দিতে হচ্ছিল অটলবিহারী   বাজপেয়ীকে, সেই পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। পরের বার শক্তি পরীক্ষা দেন তেরো মাস সরকার চালানোর পরে। তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে থেকে তিনিও বিরোধীদের তুলোধনা করেছিলেন। কিন্তু সংসদের মধ্যে যে ভাষায় নরেন্দ্র মোদী কথা বলেন, সেই ভাষায় নয়। সেই ভঙ্গিতেও নয়।

vajpayee_inside_012919054539.jpgসংসদে বলছেন অটলবিহরী বাজপেয়ী। (সৌজন্য: দূরদর্শন)

সংসদে বাজপেয়ী বললেন, আমি শুনছি অনেকে বলছেন বাজপেয়ী ভালো, তাঁর দল ভালো নয়... এটুকু বলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় তিনি থামলেন। বিরোধীরা গুঞ্জন শুরুই করে দিলেন। একজন বললেন, ঠিকই তো, তাই-ই...। এবার বাজপেয়ী বললেন, তা হলে আপনারা কী চাইছেন? বিরোধীরা চুপ, সরকারের পক্ষের সাংসদদের মধ্যে হাসির রোল।

তাঁকে বক্তৃতার মাঝে বারে বারে বাধা দেন বিজু পট্টনায়ক, মুলায়ম সিং যাদব, পদত্যাগ করতে বলেন লালুপ্রসাদ যাদবের মতো তাবড় নেতারা। তবে এক বারও মেজাজ হারাননি বাজপেয়ী, নরেন্দ্র মোদীর মতো ব্যঙ্গও করেননি। বরং তিনি যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন সেই সব যুক্তি খণ্ডন করতে পারেননি বিরোধী আসনে বসা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দরকুমার গুজরাল, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর প্রমুখ।

খণ্ডন করার উপায়ও ছিল না। কারণ তিনি উদ্ধৃত করছিলেন বিভিন্ন সময়ের লিখিত নথি। একই সঙ্গে প্রশ্নও করেছিলেন, সবচেয়ে বেশি আসন নিয়ে সংসদে আসা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে যে কোনও উপায়ে সরানো ছাড়া তাঁদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা। চুপ ছিলেন তাবড় নেতারা। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, দেশের জনতা যে দলকে সবচেয়ে বেশি আসন দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে, তাঁদের সরকার গড়তে না দেওয়া মানে জনাদেশ উপেক্ষা করা কিনা। তখনও চুপ ছিলেন বিরোধীরা।

যদিও সবচেয়ে বেশি জনাদেশ নিয়ে আসা কংগ্রেস ১৯৮৯ সালে সরকার গড়তে চায়নি বলেই বিজেপির সমর্থনে সরকার গড়েছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।

ভোটের আগে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে জোট তৈরির নীতিতেই ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) তৈরি করে বিজেপি। পরে অবশ্য সেই ধাঁচেই ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স গড়ে কংগ্রেসও, ততক্ষণে তাদের ছুৎমার্গ শেষ!

modi-rahul_012919054649.jpgসংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী: এই ভাবে নয়, বক্তৃতায় বিরোধীদের ধরাশায়ী করতেন বাজপেয়ী। (সৌজন্য: লোকসভা টিভি)

  • শপথের ১৩ দিন পরে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করতে যাওয়ার আগে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে বাজপেয়ীর মন্তব্য ছিল ক্ষুরধার – যে দেবগৌড়াকে নেতা করা হয়েছে, তিনি প্রথম পছন্দ নন, সংযুক্ত ফ্রন্টের চতুর্থ পছন্দ, তবে তিনিই দেশের প্রথম পছন্দ হতে চলেছেন।

নেতৃত্বহীন জোটের কথাও বলেছিলেন বাজপেয়ী। এখন যাঁরা সরকার গড়ার জন্য সচেষ্ট, বাজপেয়ীর এই মন্তব্য তাঁদের ক্ষেত্রেও খাটে, অন্তত নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। তবে পুরোপুরি নয়। বাজপেয়ীর বক্তব্য ছিল, ভোটের আগে কয়েকটি নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা স্থির করে, নেতা নির্দিষ্ট করে তাঁরা ভোটে লড়েছন। যে যার মতো লড়াই করে, একটা-দুটো করে আসন জিতে তাঁরা জোট করেননি।

বাজপেয়ীর জোটে তখন অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি লড়াই করে দু'টি আসন পেয়েছিল। এখন সেই বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়তে উদ্যোগী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মঞ্চে ছিলেন কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজপার্টির নেতারা – যদিও উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে জোটের বাইরে রেখেছে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজপার্টি।

বিজেপিকে যখন যে কোনও মূল্যে ক্রমতা থেকে সরাতে চাইছে বিরোধীরা, তখন বিজেপির অবস্থান কী? বিরোধী আসনে বসতে কোনও দিনই আপত্তি ছিল না বাজপেয়ীর। এমনকি কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে দেবগৌড়াকে সমর্থন করার প্রস্তাবও দিয়েছিল বাজপেয়ীর বিজেপি। এখন সেই ধরনের রাজনীতির দিন সম্ভবত শেষ হয়েছে বিজেপিতে।

কংগ্রেসের ভরসা নেই যুক্তফ্রন্টে, রাজনৈতিক সুবিধার কথা ভেবেই তারা যুক্তফ্রন্টের মঞ্চে উঠেছে। আবার প্রাদেশিক দলগুলোরও ভরসা নেই কংগ্রেসে, কারণ বারে বারেই জোট সরকারের পতনের কারণ হয়েছে কংগ্রেস। তবে সব দলেরই এখন একমাত্র লক্ষ্য বিজেপিকে হঠানো। কেন? তখন বিজেপি ভালো না হলেও বাজপেয়ী ভালো ছিলেন, আর এখন না দল ভালো, না প্রধানমন্ত্রী -- অন্তত ব্রিগেডের মঞ্চে থাকা নেতাদের তাই মত।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সমীক্ষার ইঙ্গিত অনুযায়ী এ বার ত্রিশঙ্কু লোকসভা হওয়ার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি। তাই দুই দশক আগের সেই দিন ফেরার আশঙ্কা রয়েছে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment