অসমে এনআরসির চূড়ান্ত খসড়ায় প্রায় ৭০ শতাংশ মহিলা বাদ পড়েছেন কেন?

চূড়ান্ত খসড়ায় আপত্তি কার, বাঙালি-অসমিয়া সম্পর্ক কেমন

 |  3-minute read |   04-08-2018
  • Total Shares

অসমে বর্তমান পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরে এখানে কোনও রকম অশান্তির কোনও ঘটনাই ঘটেনি। অসমে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন বাঙালি-সহ এমন প্রতিটি জনজাতির মানুষ এবং বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানের নিন্দা করছেন। তিনি অসমের পরিস্থিতি অস্থির করে তুলতে চাইছেন। অসমের শান্ত পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলে তিনি রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে চাইছেন।

mamata-nrc-body_080418022403.jpgএনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (নিজস্ব চিত্র)

তিনি হিন্দু হোন, মুসলমান হোন, বাঙালি হোন, অসমিয়া হোন, তিনি আদিবাসী হতে পারেন— অসমের প্রতিটি মানুষ এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকাকে সমর্থন করছেন। তার কারণ হল, এই তালিকায় যাঁদের নাম নেই, তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার উপায় রয়েছে। ভারতীয় নয় এমন কারও নাম যদি ভুল করে ওই তালিকায় ঢুকে গিয়ে থাকে, তা হলে যে কেউ তাঁর আপত্তি জানাতে পারেন, সেই উপায়ও রয়েছে। এই উপায় থাকায় সকলেই চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে খুশি। তাই কারও নাম যদি এই তালিকায় না থেকে থাকে তা হলে তাঁর চিন্তার কোনও কারণ নেই।

অসমের চিত্র দেশের অন্য অংশে ভুল ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আমরা জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদ দেখেছি। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই, এমনকি ব্রিটিশ শাসনকালেও, বাঙালি ও অসমিয়ারা ভাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছেন। তবে বরাক ভ্যালির তপোধীর ভট্টাচার্যের মতো কয়েকজনের মত অবশ্য ভিন্ন। তবে সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে, অসমের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এটি মন থেকে মেনে নিয়েছেন।

বরাক ভ্যালির দু-এক জন বুদ্ধিজীবী আশঙ্কা করছেন বহু সংখ্যায় বাঙালি হিন্দু বাদ পড়েছেন এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা থেকে। তবে এটি তাঁদের ধারণামাত্র। এ নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন দৈনিকে লেখালিখিও করেছেন। তাঁরা সভা করে তাঁদের বক্তব্য জানাচ্ছেন। তবে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় দেখা গিয়েছে যে এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। করিমগঞ্জ জেলা, বিশেষ করে বরাক ভ্যালিতে তিন থেকে চার লক্ষ মানুষের নাম নেই এই তালিকায়। অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে এই প্রক্রিয়া যখন চালু ছিল তাংদের অনেকেই যথাযথ প্রমাণ দাখিল করে উঠতে পারেননি। কেউ হয়তো হারিয়ে ফেলেছেন, কেউ হয়তো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁদের নথি খুইয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের বহু মহিলা তাঁদের প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। এঁদের বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের এবং বৈবাহিক সূত্রে এখানে এসেছেন। অসম সরকারের তরফে তাঁদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্য (লিগ্যাসি জেটা) চেয়ে পাঠানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই সব তথ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠানো হয়নি। এই কারণেও অনেক নাম বাদ পড়েছে। তাই এই চূড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়া নামের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই মহিলা। মূলত গুজরাট-মহারাষ্ট্র-বিহার-দিল্লি-রাজস্থান থেকে যাঁরা বৈবাহিক সূত্রে এখানে এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে।

body_assam-nrc_pti_080418022659.jpgনাম মিলিয়ে দেখা হচ্ছে এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়ায় (পিটিআই)

আসলে এই সব রাজ্যের প্রশাসনও অসমের এনআরসি নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই তাঁরা গুরুত্ব দেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন যে ওই সব মহিলাই তো ভারতীয় নাগরিক, তাঁদের আবার নতুন করে এটি প্রমাণ করতে হবে কেন! এই কারণেই অসমে জন্ম নয় এমন বহু মহিলার নাম এই তালিকায় নেই।  

এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পরে অসম সরকার বেশ কয়েকটি বিশেষ পদক্ষেপ করেছেন, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি থেকে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্য আনার জন্য।

১৯৬০-এর দশকে অসমে ভাষা নিয়ে একটি আন্দোলন হয়েছিল, তখনও পর্যন্ত সরকারি ভাষা নিয়ে কোনও ঘোষণা ছিল না। তখনও মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড ছিল অসমেরই অংশ। প্রশ্ন ছিল অসমের সরকারি ভাষা কী হবে, অসমিয়া নাকি বাংলা। অসমে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালি থাকায় এবং বহু সংখ্যায় আদিবাসী থাকায় বাঙালিরা সেই দাবির বিরোধিতা করেন। তখন দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের কিছু ঘটনাও ঘটেছিল। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ও সৌভাতৃত্ব ফিরয়ে আনতে অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ শালিহার অনুরোধে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকা।

তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে পরিস্থিতি আমার হাতের বাইরে, আমরা রাজনৈতিক ভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারব না। তখন ভূপেন হাজারিকাকে বলেছিলেন, যেহেতু জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাঁদের শ্রদ্ধা করেন, তাই তিনি যেন পুরো রাজ্য ঘুরে সকলকে শান্ত করেন। ভূপেন হাজারিকা তখন বলেছিলেন যে এই কাজ একা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়, তিনি হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সঙ্গে নিতে চান। তাঁরা দু-জনে মিলে এক মাসের মধ্যেই সব বিদ্বেষ ও ভুলবোঝাবুঝি দূর করেন।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে সকল বাঙালিকে বলতে চাই, আপনারা যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে আনন্দের সঙ্গে বসবাস করছেন, একই ভাবে আমরাও অসমে বসবাস করছি আনন্দের সঙ্গেই। আমাদের শান্তিতে বসবাস করতে দিন। দয়া করে আমাদের সৌভাতৃত্বকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করবেন না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment