নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজকে কেন মান্যতা দিলেন মোদী

প্রথম স্বাধীনতা দিবসের স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালির সবচেয়ে বড় আবেগকে স্পর্শ মোদীর

 |  6-minute read |   22-10-2018
  • Total Shares

জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যে ঠিক কতটা বিবাদ ছিল বলা মুশকিল, তবে পরবর্তীকালে তাঁদের ভক্তদের মধ্যে বিবাদ যে চরম সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতবিরোধ ছিল ঠিকই, তবে সুভাষচন্দ্র বসুই তাঁকে জাতির জনক বলে সম্বোধন করেছিলেন। গান্ধীও তাঁকে সম্বোধন করেছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক (patriot of patriots) বলে।

তাঁদের মধ্যে আদর্শগত ও রাজনৈতিক বিরোধ ও মতপার্থক্য থাকলেও ব্যক্তি হিসাবে কখনও অশ্রদ্ধামূলক কথাবার্তা শোনা যায়নি।

fb_story_19004_20170_102218044231.jpgআজাদ হিন্দ ফৌজ ও সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

রাজনীতির নেতাজি

স্বাধীনতার পর থেকে নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে বহু কথা হয়েছে, কিন্তু কখনও তাতে যবনিকা পড়েনি। তাইহোকুতে দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। কখনও বলা হয়েছে শৌলমারির সাধু হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র, কখনও বিভিন্ন ছবি দেখিয়ে দাবি করা হয় যে তাইহোকুতে দুর্ঘটনার পরে তাঁকে রাশিয়া, মাঞ্চুরিয়া ও চিনে দেখা গিয়েছে। তাইহোকু পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখা চিঠিও দেখানো হয়েছে।

২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে সিদ্ধান্ত হয় নেতাজি সংক্রান্ত সমস্ত নথি প্রকাশ করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই সব নথি পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করে (১২০০০ পৃষ্ঠা)। কিন্তু তাতে রহস্যের যবনিকা পড়েনি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক চিরকালই নেতাজির জন্মদিনকে জাতীয় দেশপ্রেম দিবস হিসাবে ঘোষণা করার দাবি করে এসেছে। তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবেও ঘোষণা করার দাবি করেছে।

সুভাষচন্দ্র বসুর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা চিরকালই চর্চার বিষয়। তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল এ কথা বেশিরভাগই মানতে চান না। অনেতেই বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার সময় থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব করা জওহরলাল নেহরুই সেই সত্য প্রকাশিত হতে দেননি।

প্রশ্ন উঠেছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত বিপুল সম্পদ নিয়েও। সেগুলি কী হল তার কোনও স্পষ্ট জবাব আজও নেই। সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে বাঙালির মনে আবেগ রয়েছে। তাই আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাদিবসকে কার্যত ভারতের স্বাধীনতা দিবসের সমান মর্যাদা দিয়ে আপামর বাঙালি তো বটেই, নেতাজি অনুরাগীদের মন জয় করতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদী।

modi-ani_102218044411.jpegপ্রথা ভেঙে লালকেল্লায় দ্বিতীয়বার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (এএনআই)

বাঙালি, নেতাজি, বিজেপি, মোদী

যোগ্য মর্যাদা তিনি পাননি, স্বাধীন ভারতে তাঁর অবদান কোনও দিনই মান্যতা পায়নি। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভারতের মুদ্রায় প্রথমে ষষ্ঠ জর্জের মুখের বদলে গান্ধীর মুখের ছবি দেওয়ার কথা স্থির করা হলেও পরে সারনাথ থেকে পাওয়া অশোকস্তম্ভকে বেছে নেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে গান্ধীর স্মারক নোট বার হয়, তারপরে ১৯৮৭ সালে ৫০০ টাকার নোটে গান্ধীর মুখ ছাপার বিষয়টি উদ্ধৃত করে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্বকে মর্যাদাই দেওয়া হয়নি।

২০১৯ সালের নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই দেখা যাচ্ছে বাংলাকেই লক্ষ্য স্থির করছে বিজেপি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই যে তাঁদের একমাত্র আদর্শ নন, বিজেপি যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতার পুজো করে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দেমাতরম্ ধ্বনিকে শ্রদ্ধা করে সে কথা বার বার বলছে। স্বামী বিবেকানন্দ যে তাঁদের আদর্শ তা বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রী নিজে বিবেকানন্দের ছবি রাখেন তাঁর অফিসের দেওয়ালে।

মেদিনীপুরে গিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ টেনেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে বাঙালির আবেগ অন্যরকম, যার সঙ্গে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা করা চলে।

নেতাজির ফাইল প্রকাশ করা ছিল বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া, অর্থাৎ অনেকটা পর্বতের মুষিক প্রসবের মতো। ভোটে সে সব কাজে আসবে না। এই অবস্থায় ভোটে জেতার সহজ উপায় হল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়। বাজেপেয়ী কার্গিল যুদ্ধজয়ের কিছুটা ফল ভোটবাক্সে পেয়েছিলেন। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পুরোনো হয়ে গিয়েছে, ভোটে তার রেশ থাকবে না। এই অবস্থায় আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাদিবসকে স্বাধীনতা দিবসের সমান মর্যাদা দিয়ে বাঙালি মন কিছুটা হলেও যে প্রধানমন্ত্রী জয় করতে পেরেছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

বাসে-ট্রামে অনেকেই একে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।

একই সঙ্গে প্রত্যাশিত ভাবেই নেহরু-গান্ধী পরিবারকে নিশানা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আগে তিনি বাঙালি আবেগ উস্কে দিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে বলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দিয়ে দেশকে একজন ভালো প্রধানমন্ত্রীর থেকে বঞ্চিত করেছে কংগ্রেস। তখনও তাঁর আক্রমণে তির ছিল গান্ধী পরিবারের প্রতি। নেতাজির ক্ষেত্রেও তিনি একই কথা বলেছেন। নেতাজি-বল্লভভাই প্যাটেল-ভীমরাও আম্বেদকরদের কংগ্রেস মর্যাদা দেয়নি একটিমাত্র পরিবারের জন্য, সে কথা যথারীতি বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

ইতিহাস ও  বিরোধীদের আক্রমণ

নেতাজিই ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী, এতদিন ভুল শেখানো হয়েছে, এবার ঠিক কী সেটা জানুন গোছের পোস্ট দিন দুয়েক ধরে এসেই চলেছে হোয়াটসঅ্যাপে। ঠিক তথ্য হল সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী

বাঙালি আবেগে নাড়া দেওয়ার পক্ষে ভালো হলেও এ ক্ষেত্রে উল্লখ্য, ১৯১৫ সালে ভারতের নির্বাসিত সরকার তৈরি হয়েছিল কাবুলে, মহেন্দ্র প্রতাপ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সরকারও প্রাথমিক ভাবে সমর্থন পেয়েছিল রাশিয়া, চিন, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের আমিরের, যদিও ১৯১৯ সালে সেই সরকার ভেঙে যায়।

netaji-andaman_102218044603.jpgআন্দামানে সেলুলার জেল পরিদর্শনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

একই ভাবে আজাদ হিন্দ সরকারের উত্তরাধিকারীও ১৯৪৭ সালের ভারত সরকার নয়। তাই কোনও ভাবেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলা যাবে না।

কাউকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলে প্রচার করা মানে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া? সুভাষচন্দ্র বসু দেশের জন্য যা করেছেন সেটুকু স্মরণ করাই যথেষ্ট, এ জন্য অকারণ ইতিহাস বিকৃত করার কোনও প্রয়োজন নেই।

লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা তোলার সিদ্ধান্ত ছিল সুচিন্তিত ও মাস্টারস্ট্রোক। এ নিয়ে বিরোধীরা যুক্তিপূর্ণ তর্ক বাধাতে পারছে না। কারণ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ স্বাধীন হওয়ার পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন (বর্তমান জাতীয় পতাকা নয়) এবং ২১ অক্টোবর ছিল আজাদ হিন্দর সরকারের ৭৫ বর্ষপূর্তি। সেই দিনটিকে একরকম প্রথম স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

কংগ্রেস চারপাতা লম্বা বিবৃতি জারি করলেও পতাকা তোলার বিরোধিতা করতে পারেনি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও এই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করছে না।

সওয়াল-জবাব

সেই দিনের স্মরণে বক্তৃতা করার সময় নরেন্দ্র মোদী বলেন, নেহরু-গান্ধী পরিবারকে খোঁচা দিয়ে বলেন, বিশেষ একটি পরিবারের গৌরবের কথা তুলে ধরতে দেশের অন্য মহান নেতাদের অবদান ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুলে যাওয়া বা অবজ্ঞা করা অত্যন্ত অন্যায়।

dwzxph_xkaagzsq_102218044909.jpgআজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগ স্বাধীনতা সংগ্রামকে অন্য মাত্রা এনে দেয়

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই দুই ভাতুষ্পৌত্র এখন দুই শিবিরে। একজন চন্দ্রকুমার বসু, তিনি বিজেপিতে। অন্যজন সুগত বসু, এখন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ। সুগত বসু জানিয়েছেন যে ইন্দিরা গান্ধী নিজেও স্মরণ করেছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান, সেখানে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো বিরোধী নেতারাও আমন্ত্রিত ছিলেন। সুগত বসুর মা কৃষ্ণা বসুও তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন, তিনিও মন্তব্য এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন যে সুভাষচন্দ্র বসু সমস্ত রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।

জাতীয় পুরষ্কার ও স্বীকৃতি

নরেন্দ্র মোদীর তোলা পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা নয়। মহাত্মা গান্ধী ও তাঁদের পরিবারের বাইরে অন্য কারও নামে তেমন পুরষ্কারও ছিল না, সরকারি প্রকল্পও ছিল না। এখন সরকারি প্রকল্পে অটলবিহারী বাজপেয়ী, দীনদয়াল উপাধ্যায়দের নাম যোগ করছে মোদী সরকার। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে জাতীয় পুরষ্কারও চালু করছে যা দেওয়া হবে সাহসিকতার জন্য।

আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য একটি জাদুঘরও তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ২৩ জানুয়ারি সেই জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম শতবর্ষে আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে স্থায়ী প্রদর্শন শরু হয়। তাই জাদুঘর গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় বহু উপাদানই মজুদ। আলাদা জাদুঘর দরকার ঠিকই, তবে একেবারে ছিল না, এ কথাও বলা ঠিক নয়।

বিজেপির দেশাত্মবোধক রাজনীতিকে কংগ্রেস কটাক্ষ করছে ঠিকই, তবে কেন এতদিন তারা স্বাধীনতার বীর সেনানীদের স্বীকৃতি দেয়নি, স কথা কোথায় বলছে? এই প্রশ্ন এখন বারে বারেই উঠছে যে যদি গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতা এসে থাকে তা হলে ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান কী?

মহাত্মা গান্ধীর ১৫০ বছর পূর্তির পাশাপাশি আজাদ হিন্দপ ফৌজের ৭৫ বছরকে বিশেষ স্বীকৃতি – গান্ধীবাদী ও সুভাষবাদী – দুই গোষ্ঠীর বাঙালিই খুশি।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment