ব্রিগেডের মঞ্চে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার কথা হলেও কেন তা সম্ভব নয়

বেশিরভাগ রাজ্যেই জোট গড়তে গিয়ে ধাক্কা খেতে পারে কংগ্রেস

 |  5-minute read |   20-01-2019
  • Total Shares

একের বিরুদ্ধে এক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেডে এটাই ছিল মূল বার্তা। তবে আরও এক কদম এগিয়ে এই সমাবেশের উদ্যোক্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারে বারে উত্তরপ্রদেশের কথা উল্লেখ করেছেন এবং শেষে বলেছেন, যে যেখানে শক্তিশালী সেখানে যেন সে-ই প্রার্থী দেয়।

b_body2_012019042834_012019073757.jpgব্রিগেডের মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (ছবি: সুবীর হালদার)

তৃণমূলনেত্রীর এই নীতি মানলে লোকসভা ভোটে কী হবে? উত্তরপ্রদেশে দু’টির বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারবে না কংগ্রেস। দিল্লিতে সাতটি আসনে কোনটি তাদের ছাড়বেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল? আরও বড় প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গে কী হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে ৪২টি আসনেই জেতার কথা ভাবছেন, যেখানে ৪২টি আসন পেলে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ প্রশস্ত হবে, সেখানে তিনি কংগ্রেসকে কোন কোন আসন ছাড়বেন? তাঁর কট্টর বিরোধী অধীর চৌধুরীর আসনটি কি ছাড়বেন?

আবার একই প্রশ্ন থেকে যায় সিপিএমের ক্ষেত্রেও। গতবারে যে আসনে সিপিএম লড়ে জিতেছিল সেই আসন কি সিপিএমকে ছাড়বেন মমতা? যদি তাই করেন তা হলে তিনি ৪২ থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে থামবেন, যদি তিনি যে আসনে প্রার্থী দিচ্ছেন সেই সবক’টি আসনে জয়ী হন তা হলেও। মমতার ঐক্যবদ্ধ ভারতের মঞ্চে সিপিএম-ও আমন্ত্রিত ছিল। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমন্ত্রণ জানালেও তিনি আসেননি। সিপিএম প্রতিনিধিও পাঠায়নি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি কংগ্রেসকে এ কথা বোঝাতে সক্ষম হন যে সর্বশেষ নির্বাচনের ফল, অর্থাৎ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী এ রাজ্যের সর্বত্র শুধুমাত্র তৃণমূলই শক্তিশালী, তা হলে কংগ্রেস তাতে কতটা রাজি হবে? আদৌ কি রাজি হওয়া সম্ভব? উত্তরপ্রদেশে তিন দলের জোট তৈরি হয়েছে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে এবং কংগ্রেসও ঘোষণা করে দিয়েছে যে তারা ৮০টি আসনের প্রতিটিতেই প্রার্থী দেবে।

অকংগ্রেস-অবিজেপি দলগুলিকে নিয়ে ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়ার প্রস্তাব যিনি করেছিলেন সেই কে চন্দ্রশেখর রাও (যিনি কেসিআর নামে পরিচিত) নিজেই এই জনসভায় আসেননি, তাঁর রাজ্য তেলঙ্গনায় তাঁর বিরুদ্ধে জোট গড়ে লড়েছিল চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ও কংগ্রেস। তারপরেও চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস) আরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিধানসভায় এবং দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন কেসিআর। যে মঞ্চে চন্দ্রবাবু নাইডু ও কংগ্রেস রয়েছে সেই মঞ্চ তিনি এড়িয়ে গেছেন। নিজের রাজ্যে বেশিরভাগ আসনই তাঁর নিশ্চিত। এখানে ত্রিমুখী লড়াই হতে পারে কংগ্রেস, বিজেপি এবং টিআরএসের মধ্যে।

dscn9140_012019073835.jpg ওমর আবদুল্লা (ডানদিকে) সমঝোতায় রাজি হলেও অরবিন্দ কেজরিওয়াল আসন ছাড়বেন কংগ্রেসকে? (ছবি: সুবীর হালদার)

অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নিজে খুব ভালো অবস্থায় রয়েছেন এমন নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ রাজ্যে আবার ওয়াইএসআর কংগ্রেসও শক্তিশালী। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা তথা অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস রাজশেখর রেড্ডির ছেলে ওয়াইএস জগন্মোহন রেড্ডি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় যেমন আসেননি, তেমনি তিনি কেসিআরের সঙ্গেও নেই বলে সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছেন। তাই অন্তত এখন যা পরিস্থিতি তাতে অন্ধ্রপ্রদেশেও কংগ্রেস-বিজেপিকে ধরে লড়াই হতে চলেছে চতুর্মুখী।

রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, পঞ্জাব, হরিয়ানা ও গোয়ায় কংগ্রেস নিজের শক্তিতে লড়বে বিজেপির বিরুদ্ধে বা এনডিএ-র বিরুদ্ধে। এই সব রাজ্যে একের বিরুদ্ধে একের লড়াই সম্ভব, কারণ মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি ও শিরোমণি অকালি দলের মতো আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপির শরিক। তামিমলনাডুর ডিএমকে দীর্ঘদিন ইউপিএ-র শরিক, স্ট্যালিনের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কও ভালো এমনকি ২০১৯ সালে রাহুল গান্ধীই প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন স্ট্যালিন। তাই তামিলনাড়ুতে জোট সম্ভব। জয়ললিতার মৃত্যু পরে তাঁর দল এডিএমকে কার্যত ভেঙে গেছে। তারা প্রার্থী দিলেও জয়ের সম্ভাবনা কম অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেই। এখানে বিজেপি এখনও পর্যন্ত শক্তিশালী নয়।

মহারাষ্ট্রে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, শিবসেনা ও কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে আসন সমঝোতা করছে বিজেপিকে হারাবে বলে, সেটা বেশ কষ্টকল্পনা।

জনতা দল সেকুলারের (জেডিএস) এইচডি কুমারস্বামী কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং রয়েছেন কংগ্রেসের অনুগ্রহে। তাই এ রাজ্যে হয়তো শেষ পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে একজন করে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব।

জম্মু-কাশ্মীরে যেহেতু আগেও কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের মধ্যে জোট হয়েছে এবং রাহপল গান্ধী ও ওমর আবদুল্লার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তাই এ রাজ্যে জোট হওয়া সম্ভব। তবে মেহবুবা মুফতি আসন সমঝোতায় রাজি হবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, ফারুক আবদুল্লা যতই ত্যাগের কথা বলুন না কেন।

কেরলে মূল লড়াই কংগ্রেস বনাম সিপিএম। এখানে বিজেপি দুর্বল হলেও আশাবাদী। তাই আসন্ন ভোটের আগে এখানেও জোট হবে না। ত্রিপুরাতে এখন একটাই দল – বিজেপি। যদিও আগের বিধানসভা ভোটের আগে পরিষদীয় রাজনীতিতে তাদের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এই অবস্থায় এ রাজ্যের দু’টি আসনে কংগ্রেস ও সিপিএম ভাগাভাগি করে লড়ে কিনা সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি।

subir_body1_012019073911.jpg করমর্দন: চন্দ্রবাবু নাইডু ও লোকসভায় কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে ব্রিগেডের মঞ্চে সৌজন্য বিনিময় করলেও অন্ধ্রপ্রদেশে আসন সমঝোতা করবেন কি? (ছবি: সুবীর হালদার)

ওড়িশায় শক্তিশালী হল বিজু জনতা হল। এখনও পর্যন্ত তারা প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এ রাজ্যে তাদের সঙ্গে যদি বিজেপির জোট না হয় তা হলে লড়াই হবে ত্রিমুখী।

বিহারে লড়াই খুব স্পষ্টতই একের বিরুদ্ধে একের হতে চলেছে। একদিকে বিজেপি, নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) ও রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) এবং অন্যদিকে কংগ্রেস, লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় লোকদল (আরজেডি) ও সহযোগীরা, যার মধ্যে উপেন্দ্র কুশওয়াহা, শরদ যাদবরা রয়েছেন।

ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেসের সঙ্গে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জোট আগে ছিল। তাই এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান দলের আসন সমঝোতা সম্ভব হতে পারে।

অসমে এখন বিজেপি শক্তিশালী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে দুই থেকে শূন্য করে দেবেন বলছেন ও উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ৭৩ থেকে (এখন অবশ্য ৭০) শূন্য হয়ে যাবে বলছেন, সেখানে তিনিই বলছেন যে অসমে বিজেপি দু’ একটা পেতে পারে। নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে অসম গণপরিষদ এখন বিজেপি জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। এই রাজ্যে আসাম ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা তথা লোকসভার সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল ব্রিগেডের মঞ্চে ছিলেন, যাঁর দল প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করেই দশটি আসনে জয়ী হয়েছে। অসম গণপরিষদ, আসাম ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের মতো দলগুলো কংগ্রেসের সঙ্গে কী ভাবে সমঝোতা করবে সেটিও বোঝা যাবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পরে।

সিকিম ধরে সমগ্র উত্তরপূর্বাঞ্চলে অবশ্য বিজেপি বা তার শরিক দলই মোটের উপরে শক্তিশালী।

আঞ্চলিক দলগুলো যে কোনও ব্যাপারে (জোট করা বা না করা) প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দ্রুত জানাতে পারলেও কংগ্রেস জাতীয় দল হওয়ায়, সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষেত্রে প্রদেশ কংগ্রেসকে অপেক্ষা করতে হবে দিল্লির বার্তার জন্য।

তাই যে সব রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী সেই সব রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়ে একজোট হয়ে লড়াই করা খুব সহজ হবে না বলেই মনে ধারনা।

ব্রিগেডের মঞ্চে যারা ছিল তাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস ছাড়া আর কেউই জাতীয় হল নয়। তাই সংঘাত বাধার সম্ভাবনা রয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গেই।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment