মোক্ষম চাল মোদীর, বিরোধিতা প্রায় নেই কোনও কক্ষেই

অনেক কথা বললেও বিলের বিরোধিতা করতে পারেনি কংগ্রেস-তৃণমূল-বিএসপি-এসপি

 |  3-minute read |   10-01-2019
  • Total Shares

রাফাল নিয়ে রাহুল গান্ধী নিজেই পিছু হঠেছেন, বিতর্কিত কথোপকথনের সত্যতা প্রমাণ না করতে পারলে তাঁর সাংসদ পদটি যেতে পারে, অরুণ জেটলির চেতাবনি শোনামাত্র (এবং লোকসভা অধ্যক্ষ সত্যতা প্রমাণ করার দায়িত্ব নিতে বলায়) তিনি সে পথে আর হাঁটার চেষ্টাও করেননি। তবে যে দেশের ভোটদাতারা ফাঁকা আওয়াজকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন এবং সেই প্রচারকে সত্য বলে বিশ্বাস করে একের পর এক নির্বাচনে শাসকদলকে ধরাশায়ী করেছে, সেখানে এই প্রচারের অভিমুখ ঘোরানো দরকার ছিল, বিশেষ করে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে যখন কোনও রাজ্যেই ক্ষমতায় আসতে পারেনি কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। তিনটি বড় রাজ্য তাদের হাতছাড়াও হয়েছে।

modireuters_011019085725.jpgমোদীর আচমকা চাল, বিরোধিতা নেই সংরক্ষণ বিলে। (ছবি: রয়টার্স)

 

একই সঙ্গে কংগ্রেসের কৃষকদরদী ভাবমূর্তির কথাও উল্লেখ করতে হবে। তিন রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়া (তাতে যে শর্ত আছে সে কথা কৃষকরা জানেন বলে মনে হয় না, কতজনের উপকার হবে তা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে) বিজেপির উপরে চাপ তো বটেই। এর উপরে আবার রয়েছে বিজেপির থেকে হিন্দুত্বের লাইন কাড়তে উপবীতধারী রাহুল গান্ধীর মন্দিরে মন্দিরে পুজো দেওয়া।

বড় তিন রাজ্য মানে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বুথফেরত সমীক্ষার হিসাব মেলেনি বটে, কিন্তু তাতে বিজেপির লাভ হয়নি। তিন রাজ্য মিলিয়ে অন্তত ১০০টি আসনে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে বিজেপি। কোথাও আবার সেই ব্যবধান নোটার চেয়েও কম। এই অবস্থায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকাদের জন্য সংরক্ষণের ঘোষণা করে নরেন্দ্র মোদী ভোটের নিরিখে বড় চাল চেলেছেন।

এই সংরক্ষণে জাত-পাত-ধর্মের কথা উল্লেখ করা না থাকলেও সংবাদমাধ্যমগুলির অতি সরলীকরণের ফলে এটিকে অনেকে উঁচু জাতের জন্য সংরক্ষণ বলে প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছে। একে গরিবদরদী ভাবনা, তাই বিরোধিতা করা সম্ভব নয়; তার উপরে বর্ণের তকমা পেয়ে যাওয়ায় তার বিরোধিতা করা আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে বিরোধীদের পক্ষে। মুখে এটিকে ভোটের আগে চমক বললেও বাস্তবে দেখা গেল যে সংসদের বিরোধিতা প্রায় হলই না!

একই সঙ্গে আরও একটি বড় চাল দিয়েছে বিজেপি – নাগরিকত্ব আইন। প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে যাঁরা সংখ্যালঘু তাঁরা এদেশে আশ্রয় নিতে এসে থাকলে তাঁদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। প্রতিবেশী বলতে যে দেশগুলির কথা বলা হয়েছে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) সেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। অর্থাৎ হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের লোক নির্দিষ্ট সময়ের আগে এ দেশে এসে থাকলে তাঁরা নাগ এখানে নাগরিকত্ব পাবেন। পাবেন না মুসলমানরা।

 rahulpti_011019085331.jpgরাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের জনমোহিনী নীতির পাল্টা সংরক্ষণ বিল।  (ছবি: পিটিআই)

রামমন্দির এখন সম্ভব নয় বুঝেই হিন্দুত্বের জোড়া তাস খেলেছে বিজেপি, প্রকৃত অর্থে যার বিরোধিতা করা মুশকিল হচ্ছে বিরোধীদের পক্ষে।

ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে বিজেপি দেখেছে যে উচ্চবর্ণের ভোট তাদের পক্ষে এলেই অন্তত রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে ফল অন্যরকম হতে পারত। তাই তারা কৌশলে এই বিল এনেছে। এই ধরনের সরকারি চালের জন্য প্রস্তুতই ছিল না বিরোধী শিবির। তাই তারা যতই সরকারকে এদিক-ওদিক দিয়ে আক্রমণ করুক, বিল পেশের সময় নিয়ে আক্রমণ করুক, কোনও ভাবেই বিলের বিরোধিতা করতে পারছে না।

দলিতনেত্রী মায়াবতীও তথাকথিত উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছেন। পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ বাড়িয়ে ৫৪ শতাংশ করার দাবি উঠলেও এই বিলের বিরোধিতা করতে পারছে না সমাজবাদী পার্টিও। বিল নিয়ে আলগোছা মন্তব্য করে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার আগেই বেরিয়ে গেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর বিরুদ্ধে যখন মুসলমানদের তোষণের অভিযোগ উঠছে, তিনি যখন নমঃশূদ্রদের নানাবিধ অধিকার দিতে ব্যস্ত তখন এই বিলের বিরোধিতা করা মানে হিন্দুরা তাঁর উপরে বিরক্ত তো হবেনই, তা ছাড়া গরিবদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে।

ls_res_011019085640.jpgলোকসভায় ভোটাভুটির ফল: বিরোধিতা নেই বললেই চলে। (সৌজন্য: লোকসভা টিভি)

যে বিল সরকার দুই কক্ষে পাস করিয়ে নিয়েছে সেই বিল অনুযায়ী বছরে ৮ লক্ষ টাকার কম রোজগার হলেই এই সংরক্ষণের আওতায় আসা যাবে। একটি সংবাদপত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৯৭ শতাংশ বাসিন্দার আয়ই ৮ লক্ষ টাকার কম। অর্থাৎ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিপুল অংশের মানুষকে জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সংরক্ষণের তালিকায় আনল বিজেপি সরকার।

 rs_res_011019085905.jpgসংরক্ষণ নিয়ে রাজ্যসভার ভোটের ফল (ছবি সৌজন্য: রাজ্যসভা টিভি)

নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতা করে অসমে বিজেপি সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে অসম গণপরিষদ। তাদের মূল বক্তব্য হল, অসম অ্যাকর্ডে এ ব্যাপারে বলা ছিল না। অনেকে বলছেন যে এর ফলে বাংলাদেশিরা এ দেশের নাগরিক হয়ে যাবেন এবং তার ফলে দেশের উপরে চাপ বাড়বে। তাই অনেকেই চিন্তিত। এর প্রভাব কিছুটা হয়তো অসমের মতো রাজ্যে পড়বে, কিন্তু একটি জোটসঙ্গী খুইয়েও সারা দেশে বিজেপি অন্তত একটি বার্তা দিতে পারবে যে বিভিন্ন জটিলতায় তারা রামন্দির গড়তে পারেনি, জম্মু-কাশ্মীরে তারা ৩৭০ ধারা বিলোপ করতে পারেনি, মেহবুবা মুফতির সঙ্গে জোট করে সরকার গড়েছিল – এই সব তথ্য যেমন ঠিক তেমন এ কথাও ঠিক যে তারা দিনের শেষে হিন্দুত্বের উপরেই আস্থা রেখেছে।

গত পাঁচ বছর ধরে যে হিন্দুরা নরেন্দ্র মোদীর উপরে বিরক্ত হয়েছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরি্ষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি হিন্দুদের জন্য কিছু করেনি বলে, এখন হয়তো তাঁরা আবার সেই নরেন্দ্র মোদীর দিকে ফিরবেন। নরেন্দ্র মোদী অন্তত সেই বিমুখ হওয়া ভোট ফেরাতেই এই মোক্ষম অস্ত্রটি প্রয়োগ করেছেন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment