বাংলার হকির এমন শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য একমাত্র কর্মকর্তারাই দায়ী

বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো হকি টুর্নামেন্টের পর এবার তালা ঝুলল দেশের সবচেয়ে পুরানো হকি সংস্থায়

 |  3-minute read |   18-11-2018
  • Total Shares

সকালে উঠেই যদি সংবাদপত্রের শিরোনাম দেখতে পান, আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্রাজিলের সান্তোস বা আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়ার্স কিংবা ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আপনার কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে? প্রথমে অবাক হবেন তারপর মেজাজটাই তেতো হয়ে যাবে। মনের দুঃখটা চিরকালের জন্য থেকে যাবে। এ দুঃখ যে সারা জীবনে ঘোচার নয়। এর কারণ এই সব ক্লাবগুলো তো শুধুমাত্র কোনও একটি দেশের ফুটবল প্রতিষ্ঠান নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কয়েকশো কোটি ক্রীড়াপ্রেমীর কাছে এই ক্লাবগুলো তো এক একটি মন্দির। বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন।

বছর দুয়েক আগে আমারও ঠিক এরকম একটা অনভূতি হয়েছিল। একদিন সকালে উঠে সংবাদপত্রে পড়লাম যে এ বছর পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ফিল্ড হকি প্রতিযোগিতা বেটন কাপ আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৭ সালের ঘটনা এটি। এর পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মনে জমে থাকা দুঃখ খানিকটা লাঘব হল। যখন বেঙ্গল হকি সংস্থা (বিএইচএ) ঘোষণা করল যে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ২০১৮ সালের বেটন কাপ অনুষ্ঠিত করা হবে।

কিন্তু এখন তো আবার যে কে সেই। অর্থ সমস্যার জন্য তালা ঝুলল দেশের সবচেয়ে পুরনো হকি সংস্থা বিএইচএ-র দরজায়। বিএইচএ বেটন কাপ পরিচালনা করেন। আয়োজক সংস্থারই যদি অস্তিত্ব না থাকে তা হলে আয়োজন কেই বা করবে? আমও গেল ছালাও গেল

body2_111818032022.jpgবন্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো হকি টুর্নামেন্ট বেটন কাপ [সৌজন্য: উইকিপিডিয়া]

কিন্তু কেন?

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো হকি টুর্নামেন্ট - যা শুধু কলকাতা, বাংলা বা ভারতের নয়, গোটা হকি বিশ্বের ঐতিহ্য - এ ভাবে বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার কে বা করা কী ভাবে অর্জন করল।

১৮৯৫ সালে শুরু হয়েছিল এই প্রতিযোগিতা। প্রথম ১৩ বছর বাংলার (সেই সময় ব্রিটিশ ভারতের) ফুটবল নিয়ামক সংস্থা আইএফএ এই টুর্নামেন্ট পরিচালনা করেছিল। ১৯০৮ সালে বিএইচএ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই সংস্থাই বেটন কাপ আয়োজন করে আসছে।

ধ্যানচাঁদ থেকে শুরু করে ভারতের, এমনকি বিশ্বের, প্রচুর নামকরা খেলোয়াড় এই প্রতিযোগিতায় খেলেছেন। একটা সময় তো হকি খেলোয়াড়দের কাছে বেটনে খেলার সুযোগ পাওয়া রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ তাঁর আত্মজীবনী 'গোল'-এ লিখেছিলেন, "আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে যে আমার খেলা সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ কোনটি আমি বলব ১৯৩৩ সালের বেটন ফাইনাল। ম্যাচটি ক্যালকাটা কাস্টমস ও ঝাঁসি হিরোর মধ্যে হয়েছিল।" যদিও ক্যালকাটা কাস্টমস ম্যাচটিতে ফেভারিট ছিল, তীব্র লড়াইয়ের পর সেই ম্যাচ ১-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে ধ্যানচাঁদের দল।

বেটন কাপের সেরা খেলোয়াড়কে রানি রাসমণি ট্রফি দেওয়া হত। ট্রফিটা সম্পূর্ণ ভাবে সোনার ছিল।

body_111818032224.jpg১৯৩৩ সালে বেটন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ধ্যানচাঁদের ঝাঁসি হিরো [সৌজন্যে; হকি গুডস]

আর সেই বেটন কী না আজ বন্ধ। গত মরসুমে হয়নি। এ মরসুমেও হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর, এর জন্য একমাত্র দায়ী বিএইচএ-র কর্মকর্তারা। ভাবতে অবাক লাগে বাংলার হকির গলা টেপার পিছনে একজন অলিম্পিয়ানও রয়েছেন!

দেশকে মোট ২৭জন অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ী, দু'জন রৌপ্যপদক জয়ী ও একজন ব্রোঞ্জ জয়ী হকি খেলোয়াড় উপহার দিয়েছে বাংলা। একটা সময় ছিল যখন ফুটবলের থেকেও এ রাজ্যে হকির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু সে সব ঐতিহ্য আজ অতীত। আজ সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। আর, রামের রাজ্য চলে যাওয়ার পিছনে বাংলার হকি প্রশাসকরাই একমাত্র দায়ী।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ভাই স্বপন বন্দ্যোপাধ্য়ায় এখন বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের উচিত বাংলার সম্মান এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে কাপক্ষেপ না করে তাঁর দিদি তথা রাজ্য়ের মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য চাওয়া। কিন্তু তিনি কি পারবেন?

body1_111818032314.jpgবাংলার হকির পতনের জন্য কর্মকর্তারাই দায়ী [ছবি: পিটিআই]

আসলে, গত দু'দশক ধরে বাংলা যে হকি প্রশাসকদের পেয়েছে তাঁরা হকি নিয়ে কোনও রকম চিন্তাভাবনা করেনি। তাঁরা হকিকে ভালোবাসতেন না। এখন তাঁরা বলছেন অর্থাভাবের জন্য এই পরিস্থিতি। অর্থ রোজগারের চেষ্টা কি তাঁরা কোনও দিনও করেছিলেন? উল্টে ধ্বংস করেছেন।

সাহারা প্রধান সুব্রত রায়ের দাদা জে বি রায় যখন বিএইচএ-র সভাপতি ছিলেন তখন প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা ছিল সেই বিরাট অঙ্কের অর্থ। সেই টাকা কী ভাবে শেষ হল, তার জবাব এই কর্মকর্তাদেরই দিতে হবে।

ইতিহাস ধ্বংসকারীদের কিন্তু ইতিহাস সহজে ক্ষমা করে না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAMIR GOSWAMI SAMIR GOSWAMI

The writer is a veteran sports journalist.

Comment