রমাকান্ত আচরেকর, যিনি ভারতীয় ক্রিকেটকে সচিন তেন্ডুলকর 'উপহার' দিয়েছেন

শুধু বিনাপয়সায়তেই ক্রিকেট শেখাননি, নেটে আউট না হলে সচিনের জন্য এক টাকা বরাদ্দ রাখতেন

 |  4-minute read |   04-01-2019
  • Total Shares

রমাকান্ত আচরেকর আর নেই। খবরটা প্রকাশ্যে আসতেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শুরু হয়ে গিয়েছে সেই মানুষটির প্রতি যিনি ভারতীয় ক্রিকেটকে সচিন তেন্ডুলকর, প্রবীণ আমরে-সহ আরও অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার 'উপহার' দিয়েছেন।

সচিনের সঙ্গে রমাকান্ত আচরেকরের যা সম্পর্ক ছিল তাতে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন। এক সাক্ষাৎকারে সচিন তাঁর ক্রিকেট জীবনের হাতেখড়ির কথা এই ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন।

"আমি টেনিস বল ছেড়ে ক্রিকেট বলে ক্রিকেট খেলা শুরু করি রমাকান্ত আচরেকরের কাছে। অজিত আমাকে আচরেকর স্যারের শিবাজি পার্কের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল যাতে আমি গ্রীষ্মকালীন শিবিরে সুযোগ পাই। সেই ক্যাম্পে যে কেউই ট্রায়াল দেওয়ার জন্য আসতে পারতেন। কিন্তু সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়ার সিদ্ধান্তটা পুরোপুরিভাবে স্যারের উপরই নির্ভর করত। সাব জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৫) ও জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৭) পর্যায়ে থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য সেখানে নির্দিষ্ট নেট ছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ১১। তাই সাব জুনিয়রদের জন্য নির্দিষ্ট নেটে আমাকে ট্রায়াল দিতে হয়েছিল। মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের একটি অনূর্ধ্ব ১৫ দল ছিল এবং এই ক্যাম্পের সাব জুনিয়র পর্যায়ের অধিকাংশ ক্রিকেটারই সেই দলে সুযোগ পেতেন।"

body_010419021846.jpgরমাকান্ত আচরেকর ও সচিন তেন্ডুলকর [সৌজন্যে: টুইটার]

সেই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, "এর আগে আমি কখনও নেটে ব্যাট করিনি আর চারপাশে এত লোক দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। এর পর স্যার যখন আমাকে ব্যাট করতে বললেন আমি একেবারে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম না। আমি একদমই ভালো ব্যাট করতে পারিনি বরঞ্চ স্যারকে নিরাশই করেছিলাম। আমার ব্যাটিং শেষ হতেই স্যার অজিতকে মাঠের এক দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে শিবিরে যোগ দেওয়ার মতো বয়স এখনও আমার হয়নি। তাই আর একটু বড় হলে আমাকে যেন নিয়ে আসা হয়। যদিও এই আলোচনার সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। মুম্বই ক্রিকেট সার্কিটে প্রবেশ করার চেষ্টা আমার শুরুতেই ব্যর্থ হত। যদি অজিত জেদ না ধরে বসে থাকত। কলোনিতে আমার খেলা দেখা অজিতের মনে ধারণা জন্মেছিল যে আমি আচেরেকর স্যারের সামনে যেমন খেলছি তার চেয়ে ঢের ভালো ক্রিকেট আমি খেলতে পারি। অজিত স্যারকে বলেছিল যে আমি নার্ভাস ছিলাম। তাই অজিত স্যারকে অনুরোধ করে আমাকে যেন ৩০ মিনিট বাদে আরও একবার আমাকে নেটে ব্যাট করতে পাঠানো হয় এবং আমার ব্যাটিংয়ের সময়ে তিনি যেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করেন। এহেন ব্যবস্থা করার কারণ হল, স্যার যে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন সেই বিষয়টি আমি যেন না জানতে পারি।"

body1_010419021958.jpgঅজিঙ্ক রাহানে পুরস্কার নিচ্ছেন রমাকান্ত আচরেকরের হাত থেকে [সৌজন্য: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস]

স্ট্র্যাটেজিটা কাজ করেছিল। সচিনের কথায়, "স্যার রাজি হয়েছিলেন আর পরিস্থিতিটাও অনেকটা বদলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আমাকে আবার ব্যাট করতে পাঠানো হল আর সেই সময়ে স্যারের নজর আমার উপর ছিল না। এ বার শুরু থেকেই আমি ছন্দে ফিরলাম আর স্যার আমাকে শিবিরে নিতে রাজি হয়ে গেলেন। এই সুযোগটা পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম আর এই সুযোগটাই আমার জীবনের মোড়টা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ে শিবিরে ভর্তি বাবদ ৬৫ টাকা করে নেওয়া হত আর প্রতি মাসে ১০ টাকা করে মাসিক চাঁদা দিতে হত। আমার ক্ষেত্রে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আমাকে আর মাসিক চাঁদা দিতে হয়নি।"

আচরেকর স্যার শুধু সচিনকে বিনেপয়সা তালিম দেননি, প্রতিদিন সচিনের জন্য এক টাকা বরাদ্দ করেছিলেন যদি যেতে সচিন আউট না হতেন। এই কয়েনগুলো এখনও সচিনের কাছে রয়েছে আর এই পুরস্কারের মূল্য কিন্তু নেহাতই কম নয়। পরবর্তীকালে, আশির দশকে, আরও একটি দৃশ্য দেখা গেল। রমাকান্ত আচরেকর সচিনকে তাঁর স্কুটারে বসিয়ে মুম্বাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন যাতে একদিনে সচিন একাধিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারেন।

body2_010419022114.jpgগুরুশিষ্য এক ফ্রেমে [সৌজন্য: টুইটার]

চোট কী করে মোকাবিলা করতে হয় সেই শিক্ষাও সচিন আচরেকর স্যারের নেটেই পেয়েছেন। "আচরেকর স্যারের নেটে চোট পাওয়ার প্রবণতা ভীষণ বেশি ছিল। পিচগুলো ভালো মানের ছিল না, তার উপর প্রচুর ব্যবহার করা হত। তার উপর স্যার আমাদের হেলমেট না পরে ব্যাট করতে বাধ্য করতেন যাতে বল ছাড়ার কৌশলটা আমরা ভালো ভাবে রপ্ত করতে পারি। পিচগুলোর বাউন্স অসমান থাকত এবং পিচগুলো বেশ চোট-প্রবন ছিল। তবে এই ছোটগুলোই ভবিষ্যতে আমাদের শক্তিশালী করে তুলেছিল। এর ফলেই ভবিষ্যতে আমি চোট-আঘাতে ভয় পেতাম না। স্বাভাবিক নিয়মে আমি মাঝে মাঝে চোট পেতাম এবং ব্যাথা সহ্যও করতে পারতাম। ক্রীড়াবিদ হিসেবে চোট আমার পেশারই অঙ্গ। আমি অবশ্য ক্রিকেট জীবনে খুব বেশি চোট পায়নি। এর জন্য আচরেকর স্যারকে ধন্যবাদ।"

অমায়িক এই মানুষটি তাঁর ছাত্রদেরও বিনয়ী ও সুশীল থাকতে শিখিয়ে ছিলেন - যার প্রতিফলন আমরা সচিন ও প্রবীণ আমরের মধ্যে দেখতে পাই। একজন ভারত রত্ন ও কোটি কোটি মানুষের রোল মডেল হয়ে উঠতে পারা বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার 'উপহার' দেওয়ার জন্য রমাকান্ত আচরেকরের নাম আজীবন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে রয়ে যাবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BORIA MAJUMDAR BORIA MAJUMDAR @boriamajumdar

Rhodes scholar, Sr. Research Fellow at the Univ. of Central Lancashire & Adjunct Professor Monash University Melbourne.

Comment