অভিজিৎ আইয়ার-মিত্রর ঘটনা দেখিয়ে দিল আমাদের মৌলিক অধিকারের সার

ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের নেই, নাগরিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া যায়

 |  6-minute read |   08-12-2018
  • Total Shares

আমরা এমন এক স্বাধীন দেশে বাস করি যে দেশে সবচেয়ে জরুরি ভাবপ্রকাশের অধিকারও সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে এবং সেই সংবিধান মেনে দেশ চালায় গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার। যদি কারও কাছ থেকে এই অধিকারটি কেড়ে নেওয়া হয়, তা হলে অন্য সব অধিকারই অর্থহীন হয়ে যায়।

constituton-inside_1_120818051051.jpgআমাদের বলা হয়েছে যে এই একটিমাত্র গ্রন্থই অনুসরণ করতে হবে – কিন্তু এটাই কি মৌলিক সত্য? (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

আমাদের বলা হয়েছে যে সংবিধানই একমাত্র গ্রন্থ যা আমাদের মেনে চলতে হবে। এটি একটি জলজ্যান্ত দলিল যেটি প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা যেতে পারে। তবে কখনও রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তাগিদে এবং কখনও সংবিধানের মূল ভাব অগ্রাহ্য করেও অবশ্য সেটিকে সংশোধন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বহু বারই এমন ঘটনা ঘটেছে। কোনও একটি মহলের প্রবল চাপ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটি সংশোধন করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম বার সংবিধান সংশোধন করেছিল তখন ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতায় অন্তরায় হতে পারে এমন সব অংশ তারা বাদ দিয়ে দিয়েছিল। আমেরিকার পথ সুন্দর বলেই আমেরিকা মহান রাষ্ট্র এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই, বরং তারা যে পথ তৈরি করেছে সেই পথে মৌলিক অধিকার কোনও ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয় না – এটাই তাদের মহত্ব। আজ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ছিছিক্কার করছেন মার্কিনরা, কারণ তিনি যে পদক্ষের করছেন তাতে ভাবপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

trump-inside_1205180_120818051137.jpgআমেরিকার সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকারের উপর নজর পড়েছে তাঁর (ছবি:এপি/ফাইল)

ভারতের প্রথম সংবিধান সংশোধনও ছিল ভাবপ্রকাশের অধিকার সংক্রান্ত। বামপন্থী রমেশ থাপারের পত্রিকা ক্রস রোডস-এ তাঁর নীতি যা লেখা হত তা পছন্দ করতেন না প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এই জন্যই আমাদের সংবিধান প্রথম বার সংশোধন করা হয়।

আমেরিকা তাদের প্রথম সংবিধান সংশোধনে যা করেছিল আমরা আমাদের প্রথম সংবিধান সংশোধনে ঠিক তার বিপরীত কাজটিই করেছি – প্রথমেই আমরা ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি।

new-nehru_1205180837_120818051216.jpgপণ্ডিত নেহরু ছিলেন মহান ব্যক্তি। তবে আমাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তাঁর মহত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। (ছবি সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)

তখন বলা হয়েছিল ‘যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ’, তবে যুক্তিসঙ্গত ব্যাপারটা ছিল আপেক্ষিক। আমাদেন নেতারা এমন একটা অস্পষ্টতা জুড়ে দিলেন যা মৌলিক  অধিকারকে খর্ব করে: ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ধারার ১ নম্বর অনুচ্ছেদের ক-তে কী বলা হয়েছে পড়ে দেখুন:

১ নম্বর অনুচ্ছেদের ক উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তার বলে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হয়, দেশের নিরাপত্তার উপরে প্রভাব পড়তে পারে, কোনও দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে, সরকারি নির্দেশ, শিষ্টাচার ও নৈতিকতা অথবা আদালত অবমাননার সঙ্গে যুক্ত বা প্ররোচনা দিতে পারে এমন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত পারে এবং রাষ্ট্রকে কোনও আইন তৈরি থেকে বিরত রাখতে পারে এমন কিছু করা যাবে না এবং করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।

সমস্ত শব্দের অর্থই বোধগম্য শুধু ওই ‘শিষ্টাচার’ ও ‘নৈতিকতা’ শব্দদু’টি বাদ দিয়ে।

‘শিষ্টাচার’ ও ‘নৈতিকতা’ কাকে বলে এবং কে তা নির্ধারণ করবে?

একটি হিন্দি প্রবচন অনুযায়ী লাঠি যার মোষ তার, মানে বাংলায় লাঙল যার জমি তার-এর মতো। প্রবাদ-প্রবচন দূরে সরিয়ে বলতে হয় যে শুনতে খারাপ লাগলেও অশিষ্টাচার ও অনৈতিক দেশ-কালের ক্ষেত্রে এই ‘শিষ্টাচার’ ও ‘নৈতিকতা’ কী হবে?

এ কথাই আমরা দেখলাম অভিজিৎ আইয়ার-মিত্রর ক্ষেত্রে।

আইয়ার-মিত্র সরস ভাবে একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, তা হল কোণার্ক মন্দিরে যে সব যৌন-দৃশ্য বর্ণিত রয়েছে সেই বিষয়টি। এক দিন যাকে আমরা শিষ্টাচার ও নৈতিকতা বলে মনে করতাম আজ তা শিষ্টাচার ও নৈতিকতা বলে মনে নাও হতে পারে। এখনও মন্দিরের যে ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এবং সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে যে সব শিষ্টাচার ও নৈতিকতার নিদর্শন রয়েছে তা আজকের দিনে সম্ভব নয়, কারণ এটি মন্দির! ধর্মপ্রাণ কোনও হিন্দু না পারবে কোনও দিন এই সব মিলনদৃশ্য উপেক্ষা করতে, না পারবে সেই মন্দির ধ্বংস করতে।

iyer_120518082623_120818051242.jpg অভিজিৎ মজা করেছেন, তিনি জানতে না যে এই মজা তাঁর কাথে মারাত্মক ভাবে ফিরে আসবে (ছবি: টুইটার)

ওড়িশার খাবারদাবার, ওড়িশার মানুষজন বা ওড়িশা – কোনও কিছুই অপছন্দ করেন না অভিজিৎ আইয়ার-মিত্র। কেউ যদি মজাচ্ছলে কোনও কথা বলে থাকেন তা হলে এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে তিনি সেটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। তিনি রাজনীতিতে তেমন দড় নন, তাই তিনি মজাচ্ছলে যে কথা বলেছেন অনেকেই তাতে মজা পাননি। তিনি দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকুন না বামপন্থার দিকে, প্রতিটি মানুষের কিছুটা হলেও হাসিঠাট্টা বোঝার মতো ন্যূনতম রসবোধ থাকা একান্তই প্রয়োজন। 

একটু মজা করার ফলে টুইটার-সর্বস্ব কয়েকজনের জন্য তাঁকে নিজের স্বাধীনতা দিয়ে মূল্য চোকাতে হল। এক মাসের বেশি সময় কারাবাসের পরে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়েছে। আমরা সভয়ে দেখেছি সেই অবিবেচক বিচারক, স্থানীয় আদালতের হরতাল এবং সর্বোপরি সেই প্রবল প্রতিকূল রাজনৈতিক বিধান যার ফলে ওই ‘মানসিক’ শব্দটিই মৌলিক এবং অধিকারের সাপেক্ষে বেসুরো গাইতে শুরু করে দিল। আইন আইনের পথে চলেছে। দ্ব্যর্থক শব্দ প্রয়োগের পুরো মজাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

জর্জ কার্লিন একবার বলেছিলেন যে, হয়তো এটা কেড়ে নেওয়া যাবে, তা তা উচিত হবে না। কারণ এটি নাগরিকের অধিকার। আমরা মনে করি যে আইনপ্রণয়নকারীরা আমাদের যে মৌলিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার দিয়েছেন, সেই সব অধিকারই আমাদের রক্ষা করবে আইনরক্ষকদের হাত থেকে। কিন্তু আমাদের গঠনতন্ত্র যে রকম পরিবর্তনশীল তাতে যে কোনও সময় সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হতে পারে, কারণ এই গঠনতন্ত্র তাকে মৌলিক অধিকার বলে মনে করে না।

কার্যত একদিন অন্তরই আমরা এই ধরনের খবর দেখতে পাই যে, ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী, দেবতা বা কোনও পয়গম্বরের (আদিকালের হোক বা এই যুগের) সমালোচনা করায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা খবরটা পড়ে পরের খবরে চলে যাই। একজন ব্যক্তি হিসাবে আমরা সেটিকে একটি ব্যক্তিগত মামলার দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিচার করে থাকি, কখনও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করি না। নাগরিকদের অধিকার ক্রমেই খর্ব হয়ে চলেছে এবং আমরা কেবল চিন্তিত আমাদের গোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে।

জাটরা যখন বিক্ষুব্ধ: জনতা সবসময়ই ঠিক, এমনকি যখন তারা পুরোপুরি ভুল তখনও। (ছবি: পিটিআই)

জনা পঞ্চাশেক উচ্ছৃঙ্খল লোক মিলে একটি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে প্রশাসনকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করতে পারে। একদল লোক কোনও একটি গোষ্ঠীর দাবি নিয়ে মিছিল করতে পারে এবং তাঁদের তুষ্ট করতে মন্ত্রীকে নেমে আসতে হতে পারে – নির্দিষ্ট জাত, ধর্ম, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, এটা-ওটা-সেটা – তারা যে কোনও গোষ্ঠীরই প্রতিভূ হতে পারে। পিছনের দিকে হেঁটে নতমস্তকে এই সব গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার জন্য সরকার সদাপ্রস্তুত।

অভিজিৎ আয়ার-মিত্রর মৌলিক অধিকার পদদলিত হয়েছে কারণ একজন ব্যক্তির অধিকারকে পরাজিত করতে পেরেছে একটি গোষ্ঠীর অনুভূতি।

রাজ্য সরকার যখন স্থির করল যে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও পদক্ষেপ করবে না তখনই তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

এই মামলাকে কেউই সমর্থন করেননি। এটি ছিল তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার একটি কৌশল, এখানে বিচার হয়নি, একটি নির্দিষ্ট বিচারপদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনও ধরনের বিচার শুরুর আগেই যা শাস্তি পাওয়ার তা তিনি পেয়ে গেছেন। একটু মজা করার জন্য এক মাসের কারাবাস! যদি রসিকতার জন্য এমন ঘটনা না ঘটত তা হলে হয়তো ঘটনাটি বেশ মজার হত।

কারও আনুগত্য, ধর্ম, জাত সবকিছু মেনেও একজন ব্যক্তি হল সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু। এক এক করে এই সংখ্যালঘুদের নিয়েই এই দেশ গড়ে উঠেছে। আমরা যতদিন পর্যন্ত একটি গোষ্ঠীর অধিকারের চেয়ে যথোপযুক্ত ভাবে একজন ব্যক্তির অধিকার কায়েম না করতে পারব, তত দিন আমরা নিজেরাই তার শাস্তি ভোগ করব এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনের দিকে দেশকে নিয়ে যাব। যে সব লোক গরিষ্ঠতার কথা বলে রোদন করেন তাঁদের এই উপলব্ধি আসা উচিত যে তাঁরা একটি গোষ্ঠীর হয়ে কথা না বলে প্রথমে প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবেন, হ্যাঁ, মৌলিক অধিকার।

তা না হলে সংবিধানের ১৯ ধারা হাস্যকর হয়ে যাবে এবং প্রতিবার শেষ হাসি হাসবে শাসকদলই।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

https://www.dailyo.in/politics/abhijit-iyer-mitra-gets-bail-odisha-konark-temple-freedom-of-expression-fundamental-rights/story/1/28167.html

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

KAMLESH SINGH KAMLESH SINGH @kamleshksingh

Journalism student. Ed honcho at the India Today Group Mediaplex. God's Loyal Opposition. Useful Warning: Tweets may hurt religious sentiments.

Comment