ইমার্জেন্সি গেট খুলে দেওয়া থেকে লাইফজ্যাকেট নিয়ে নেমে পড়া, নিত্যদিন ঝামেলা বিমানে
বিমান সংস্থার কর্মীরা নিজেদের স্বার্থে ভুল পুনরাবৃত্তি করতে চান না, কিন্তু যাত্রীদের সেই বালাই নেই
- Total Shares
২০০৯ সালের ঘটনা। ভারতের আকাশে কিংফিশার এয়ারলাইন্স তখন রমরমিয়ে ব্যবসা করছে। একদিন সকালে বিমানসংস্থার কলকাতা-পোর্ট ব্লেয়ার ফ্লাইটে ঘটে গেল এক বড়সড় বিপত্তি। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা চার সদস্যের এক পরিবার ছুটি কাটাতে সেই বিমানে আন্দামান যাচ্ছিল। পরিবার বলতে এক দম্পতি ও তাঁদের দুই কিশোর পুত্রসন্তান।
ইমার্জেন্সি গেটের লাগোয়া আসনগুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তাঁদের জন্য। বিমানে বসে কৌতূহলবশত ইমার্জেন্সি দরজার সঙ্গে লাগানো হাতলটি টেনে দেয় দুই ভাইয়ের একজন। খুলে যায় বিমানের এমার্জেন্সি দরজা। হৈ হৈ শুরু হয়ে যায় বিমানের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত সেই পরিবারটিকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটির সেই অতিরিক্ত কৌতূহলের জেরে সেদিন বিমানটি প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক দেরিতে ছেড়েছিল।
২০০৮ সালের ঘটনা। এক সকালে বাংলাদেশি এক বৃদ্ধ তাঁর ছেলেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক টার্মিনালের সিকিয়োরিটি গেটে এসে পৌঁছালেন। চিকিৎসার জন্য সেই বৃদ্ধ ছেলেকে সঙ্গে করে চেন্নাই গিয়েছিলেন। আগের দিন রাতে জেট এয়ারওয়েজের বিমানে কলকাতায় এসেছিলেন। শহরে এক রাত কাটিয়ে সেদিন তাঁরা বাংলাদেশগামী বিমানে চড়বেন। কিন্তু সিকিয়োরিটি গেটে বৃদ্ধের হ্যান্ডব্যাগেজ পরীক্ষা করতে গিয়ে সিআইএসএফ জওয়ানদের চক্ষু চড়কগাছ।
চেক-ইন কাউন্টারে বিভিন্ন ঝামেলার সৃষ্টি হয় [ছবি: পিটিআই]
হ্যান্ডব্যাগেজ বলতে একটি থলে। সকালে বাজারে যাওয়ার সময় এ ধরণের থলে আমরা ব্যবহার করে থাকি। তা সে বৃদ্ধের সেই থলি থেকে সিআইএসএফ জওয়ানরা একটি লাইফ জ্যাকেট উদ্ধার করলেন। এই লাইফ জ্যাকেটটি জেট এয়ারওয়াজের বিমানের। আগের দিন চেন্নাই থেকে ফেরার সময় বৃদ্ধ সিটের তলা থেকে তা খুলে নিয়ে থলেতে পুরে ফেলেন। জেরার মুখে বৃদ্ধের অকপট স্বীকারোক্তি, বিমানে খাবার থেকে শুরু করে চা, জল সব কিছুই বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছিল। তাই তিনি ভেবেছিলেন এই লাইফ জ্যাকেটটিও যাত্রা শেষে তিনি বিনামূল্যে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।
অবশেষে জেট সরকারি ভাবে কোনও অভিযোগ জানায়নি বলে বৃদ্ধকে ছেড়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাঁর বিমান ততক্ষণে উড়ে গিয়েছে। যে এয়ারলাইন্সের বিমানে তাঁর যাওয়ার কথা ছিল সেই সংস্থারই বিকেলের বিমানে তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল।
এবার আসি এ বছরের একটি ঘটনায়। দিল্লির এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী কলকাতায় এসেছিলেন পুজোর ছুটি কাটাতে। ফেরার সময়ে তাঁর স্পাইস জেটের সন্ধ্যার বিমানে টিকিট কাটা ছিল। তিনি এতটাই মত্ত অবস্থায় তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছালেন যে স্পাইস জেটের বিমানের জন্য নির্দিষ্ট চেক-ইন কাউন্টারে না গিয়ে চলে গেলেন জেটের জন্য নির্দিষ্ট চেক-ইন কাউন্টারে। জেটের আধিকারিকদের অভিযোগ, এরপর বিমান সংস্থার কর্মচারীদের উদেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দেন তিনি। আর কোনও উপায় না দেখে বিমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তাঁর আর সেদিন দিল্লি যাওয়া হল না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। তাঁর রেশ চলল পরের দিনেও। সেদিন জেট কর্তৃপক্ষ কোনও অভিযোগ না করায় গভীর রাতে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। রাতে বাইপাস লাগোয়া একটি হোটেলে ওঠেন তিনি। পরেরদিন আবার বিমানের টিকিট কাটেন। এবার জেটের সন্ধ্যার দিল্লিগামী বিমানে। কিন্তু জেট কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিমানে উঠতে দেননি। সেদিনও দিল্লি যেতে পারলেন না তিনি।
জেটের আধিকারিকদের অভিযোগ, সেদিনও এতটাই মত্ত অবস্থায় ছিলেন তিনি যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। হোটেলের এক লিয়াজঁ আধিকারিক (বড় বড় হোটেল থাকে) তাঁকে সঙ্গে করে চেক-ইন কাউন্টারে নিয়ে এসেছিলেন। তিনিই আবার তাঁকে এসকর্ট করে বিমানবন্দর থেকে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রায় প্রতিদিনই এই ধরণের উটকো ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয় বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মী আধিকারিকদের। কখনও সেই ঝামেলার অভিজ্ঞতা বেশ মজার হয়। কখনও আবার সেই ঝামেলার অভিজ্ঞতা বেশ বিরক্তিকরও হয়। কিন্তু নিয়মিত এই ধরণের ঝামেলার সম্মুখীন হওয়ার কারণটা কী?
বিমান সংস্থার পরিচিত কর্মীদের সঙ্গে বহুবার এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনাগুলোতে এই ধরণের ঘটনারগুলোর পিছনে তিনটে সম্ভাব্য কারণ উঠে এসেছে।
উটকো ঝামেলা লেগেই থাকে বিমানবন্দরে [ছবি: পিটিআই]
ফার্স্ট টাইম ট্রাভেলার বা প্রথম বার যাঁরা বিমান চড়ছেন তাঁরা এই ধরণের ঝামেলা সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে কিছু লোক আছেন যাঁরা বিমান চড়া সম্পর্কে কিছুই জানেনা না বলে (মানে সাধারণ নিয়মাবলি) এই ধরণের উটকো ঝামেলা সৃষ্টি করেন। আবার একদল রয়েছেন যাঁরা শুধুমাত্র কৌতূহল নিবারণ করতে সমস্যা তৈরি করেন। যেমন কিংফিশারের সেই কিশোর যাত্রী, যিনি শুধুমাত্র কৌতূহল মেটাতে ইমার্জেন্সি গেটের হাতল টেনে দিলেন।
যাঁরা নিয়মিত যাত্রী তাঁরাও এই ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকেন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য। দিল্লির সেই বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি যেমন। ডোমেস্টিক ফ্লাইটে মদ দেওয়া হয় না, আন্তর্জাতিক বিমানে দেওয়া হয় তাও নির্দিষ্ট পরিমাণে। সেই লোকটি নিয়মিত বিমানে চাপেন বলে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তাঁকে কেউ আটকাবেন না। ফার্স্ট টাইম ট্রাভেলার বা অনিয়মিত বিমান যাত্রীরা এই সাহসটা দেখাতে পারতেন না। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। এমনকি, মদ্যপানের সময় তিনি ভেবে দেখলেন না যে তাঁর আচরণ সহযাত্রীরা পছন্দ নাও করতে পারেন।
আরও একটি কারণে বিমানবন্দরে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। তা হল সেলিব্রিটি বা রাজনৈতিক নেতানেত্রীর আচার আচরণে। দেরিতে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে চেক-ইন কাউন্টারের সামনে এসে হম্বিতম্বি করার উদহারণ নেহাত কম নেই।
২০০৭ সালের যেমন সিপিএমের যাদবপুরের বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী জেটের বিমানে মুম্বাই যাচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি যাদবপুর লোকসভা আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ। বিমানবন্দরে দেরিতে পৌঁছালে তাঁকে বোর্ডিং পাস দিতে অস্বীকার করেন বিমান সংস্থার কর্মীরা। চেক-ইন কাউন্টার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। কিন্তু সাংসদ কোনও কথাই শুনতে রাজি হননি। উল্টে তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন বিমান সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে। জেটের আধিকারিকদের অভিযোগ, তিনি নাকি 'চাকরি খেয়ে নেওয়ার' হুমকিও দিয়েছিলেন। জেটের আধিকারিকরা সেদিন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। এর ফলে সাংসদ বাধ্য হন সেদিনের দুপুরের অন্য একটি বিমানের টিকিট কেটে মুম্বাই যেতে।
সেলিব্রিটি বা রাজনৈতিক নেতাদের এই ধরণের আচরণের খবর তো প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়ে থাকে। তাও অনেকেই নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে এই ধরণের কাজ করেই থাকেন।
ভুল বিমানে চেপে অন্য গন্তব্যে পৌছিয়ে যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে [ছবি: পিটিআই]
তবে কিছু ক্ষেত্রে উটকো ঝামেলার জন্য বিমান সংস্থার কর্মীরাও দায়ি থাকেন।
যেমন ২০০৯ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেই বিমানে দু'টি দম্পতি যাত্রা করছিলেন। সিঙ্গাপুর থেকে বিমানটি কলকাতা হয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা। এই দুই দম্পতির মধ্যে একটি দম্পতি ভারতীয়, তাঁরা দিল্লির বাসিন্দা। কলকাতায় নেমে অন্য একটি বিমান চড়ে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। অন্য দম্পতি বাংলাদেশের নাগরিক। সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতায় এসে তাঁদের বিমানেই বসে থাকার কথা। সেই বিমানেই তাঁরা ঢাকা যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশী দম্পতি কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে গেলেন। আর দিল্লিগামী ভারতীয় দম্পতি বিমানেই বসে রইলেন।
বাংলদেশের সেই দম্পতি যখন বিমানবন্দরের অভিবাসন কাউন্টারে এলেন তখন বিষয়টি প্রথম নজরে এল। ততক্ষণে, ভারতীয় দম্পতিকে নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ঢাকার উদেশ্যে রওনা হয়ে গিয়েছে।
২০০৭ সালে এমন একটি ঘটনা কিংফিশার বিমানেও ঘটেছিল। একজন যাত্রী দিল্লি হয়ে ওয়ারশ যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভুল করে তিনি সেই বিমান সংস্থারই মুম্বাইগামী বিমানে মুম্বাই পৌছিয়ে যান।
এই ধরণের ভুল মেনে না নেওয়া গেলেও এই দু'টি ঘটনা কিন্তু ভুল করে হয়েছে। বিমান সংস্থার আধিকারিকরা অবশ্য এই ধরণের ভুল পুনরাবৃত্তি করতে কখনই পছন্দ করেন না। কারণ সে ক্ষেত্রে কতৃর্পক্ষের চোখ রাঙানি ছাড়াও উটকো ঝামেলা তাঁদের ঘাড়ে এসে পড়ে।
কিন্তু যাত্রীরা কী নিজেদের ভুল শোধরাবে? দিল্লির সেই বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মীর আচরণ দেখে সে কথা তো মনে হচ্ছে না।