১৯৯১ সালের ব্যর্থতা কী ভাবে ২০১০ সালে বাঙালিকে এভারেস্টের শিখরে নিয়ে গেল

চূড়ায় পৌঁছাতে পারিনি, তবে ভবিষ্যতে বাঙালির সফল অভিযানের পথ তৈরি করে দিয়েছিলাম

 |  4-minute read |   15-05-2018
  • Total Shares

দেখতে দেখতে ২৭ বছর কেটে গেল। বড় সুদীর্ঘ এই সময়। আর, আজ এত বছর পরে স্মৃতিরোমন্থন করতে বসে আমার সমীরদার কথা মনে পড়ছে। সমীরদা মানে সমীর রায়। পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। একটা সময় দেশ পত্রিকায় লিখতেন। তাছাড়া বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন। তবে সমীরদাকে আর পাঁচটা বাঙালির মতো ভ্রমণ পিপাসু বলা যাবে না। বরঞ্চ একটু সাহেবি কায়দায় তাঁকে ট্র্যাভেল ফ্রিক বলাটাই বোধহয় শ্রেয়।

আপনারা হয়ত ভাবছেন বাঙালির এভারেস্ট অভিযান সম্পর্কে লিখতে বসে আমি কেন একজন ট্র্যাভেল ফ্রিক সাংবাদিকের গল্প শোনাচ্ছি। বাঙালি অভিযাত্রী দলকে প্রথমবারের জন্য এভারেস্টের পাদদেশে পৌছিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা সবচেয়ে বেশি তিনিই দাবি করতে পারেন।

সেই সময় আমাদের ধারণা ছিল আইএমএফের সাহায্য ছাড়া ভারতীয়দের পক্ষে এভারেস্ট অভিযান সম্ভব নয়। আর, আইএমএফ অভিযানে মূলত সেনাবাহিনীর লোকেরাই সুযোগ পান। একদিন ট্রান্স সার্বিয়ান ট্রেনে সফর করবার সময় সমীরদার সঙ্গে এক আর্জেন্তেনীয় অভিযাত্রী দলের আলাপ হয়। ওই আর্জেন্তেনীয় দলের সঙ্গে কথা বলে সমীরদা প্রথমে জানতে পারেন যে সরাসরি চিনের সরকারের সঙ্গে কথা বলে অনুমোদন জোগাড় করতে পারলে যে কেউই এভারেস্ট অভিযানে অংশগ্রহণ করতে পারে।

body1_051518121441.jpgপ্রথম এভারেস্ট অভিযানেই 'কেল্লা ফতে' করতে পারেনি বাঙালি

দেশে ফিরে সমীরদা মাউন্টেনিয়ারিং জগতের লোকদের সঙ্গে এই বিষয় আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিলেন। অবশেষে ৯০এর শেষের দিকে এই আলাপ আলোচনা ফলপ্রসূ হল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ দপ্তর ও ভরুকা মাউন্টেনিয়ারিং ট্রাস্ট যৌথ্য উদ্যোগে এভারেস্ট অভিযানের আয়োজন করবার সিদ্ধান্ত নিল। বাঙালির এভারেস্ট অভিযানের স্বপ্ন পূরণ হল।

প্রাথমিকভাবে ৪০জন অভিযাত্রীকে বেছে নেওয়ার পরে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। কখনও বিভিন্ন ছোট ছোট পাহাড়ে অভিযান আবার কখনও ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে চলল কঠোর অনুশীলন। এর পর এই ৪০জনের দল থেকে চূড়ান্ত ২১ জনকে (একজন ম্যানেজার ও দু'জন চিকিৎসককে) বাছাই করে নেওয়া হল। ঠিক হল প্রথাগত এবং অপেক্ষাকৃত সাউথ কল রুট দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে আমরা যাব না। বরঞ্চ নর্থ ফেস রুট দিয়ে মধ্য রংবুক হিমবাহ হয়ে আমরা এভারেস্ট অভিযান করব বলে সিদ্ধান্ত হল।

তবে প্রথম অভিযানেই 'কেল্লা ফতে' করতে পারল না বাঙালি। আমরা যে রুট ধরে যাচ্ছিলাম সেই রুটের ৬,৮০০ মিটার থেকে ৭,৭০০ মিটার জায়গা জুড়ে থাকা অঞ্চলটিকে ওয়াইট লিম্বো বলা হয়। অত্যন্ত দুর্গম এই অঞ্চলটি। ভারী বর্ষণের প্রভাব এই অঞ্চলের উপর সবচেয়ে বেশি পড়ে। আমরা সেপ্টেম্বরে মাঝামাঝি এই অঞ্চলে পা দিয়েছিলাম। সবে মাত্র বর্ষা শেষ হয়েছে আর সেই সময় বরফগুলো একেবারে ধূলিকণার মতো মিহি। আমরা ফেঁসে গেলাম। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা প্রায় ৭,৪০০ মিটার অবধি উঠে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অনেকদিন ধরেই তুষারধ্বস শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে একদিন এক বিকট ধ্বসের জন্য আমাদের অভিযান বাতিল করে দিতে হলো।

ভাঙ্গা মন নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। এই রকম দুর্গম একটি পথ বেয়ে এভারেস্টের ৭,৪০০ মিটার অবধি উঠে যাওয়ার জন্য আমরা যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিলাম। কিন্তু একটা চাপা আফসোস রয়েই গেল। এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন কি অধরাই রয়ে যাবে? আবার কি এভারেস্ট অভিযানের সুযোগ আসবে?

দু'বছরের মধ্যেই সুযোগ এল। এবার সাত সদস্যের বাঙালি দল রওনা দিলাম এভারেস্ট জয় করতে। ৯৩ সালে আমরা নর্থ কল রুট ধরে পূর্ব রংবুক হিমবাহ দিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম। এবারের আমরা আরও বেশি অভিজ্ঞ, আরও বেশি অভিজ্ঞ। আর এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই আমরা ৮,২০০ মিটার অবধি পৌছিয়ে গিয়েছিলাম। এভারেস্টের ৮,২০০ মিটারে উঠে আমরা আমাদের চতুর্থ ক্যাম্প তৈরি করলাম।

ভাবতে পারেন, বাঙালি দল তাঁদের দ্বিতীয অভিযানেই এভারেস্টের শিখর থেকে মাত্র ৬০০-৬৫০ মিটার দূরে ক্যাম্প স্থাপন করছে। আজও বিষয়টি ভাবলে আমি শিহরণ অনুভব করি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কোথায়?

চার নম্বর ক্যাম্প স্থাপনের পরে উচ্চ উচ্চতার আবহাওয়ার সঙ্গে সড়গড় হতে আমরা আবার নিচের ক্যাম্পে নেমে এলাম। ঝকঝকে আবহাওয়া। তাই ঠিক করলাম তিন নম্বর ক্যাম্পটিতে কিছুদিন থেকে সড়গড় হয়ে যাই। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস। যখন মনে হচ্ছিল সব কিছু ঠিকঠাক তখনই আবহাওয়া বিগড়ে গেল। শুরু হলো তুষারঝড়। রীতিমতো ১৪০ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে। তাপমাত্রার পারদ এক ধাক্কায় নেমে এল মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর মধ্যেই গোদের উপর বিষফোঁড়া দেখা দিল। ওই ক্যাম্পে থাকা আমার সঙ্গে থাকা আরও দুই সঙ্গী ফ্রস্টবাইটে আক্রান্ত হলেন। তাও আবার দুই হাতে। আর সময় নষ্ট না করে আমরা অভিযান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলাম।

তীরে এসে ফের ডুবল বাঙালির এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নের তরী।

body_051518121549.jpg২০১০ সালের মে মাসের এক ভোরে মাউন্ট এভারেস্টে পা রাখলেন বসন্ত সিংহরায় ও দেবব্রত বিশ্বাস

না, আমি আর মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে যায়নি। শুধুমাত্র অপেক্ষা করে গেছি এই ভেবে যে কোনও না কোনও দিন কোনও এক বাঙালি এভারেস্টের চূড়ায় তিরঙ্গা পতাকা পুঁতে দিয়ে আসবে। এর পর বাংলা থেকে যাঁরা এভারেস্টে গিয়েছে তাঁদের অনেকেই আমাদের দলের সদস্যদের কাছে পরমার্শ নিয়েছেন। হাজার হোক, ব্যর্থ হলেও, ৮,৮৪৮ মিটারের মাউন্ট এভারেস্টের ৮,২০০ মিটার অবধি তো আমরা পৌঁছাতে পেরেছিলাম।

কিন্তু কোথায় কী? দেখতে দেখতে আমাদের অভিযানের ১৯ বছর কেটে গেল। কিন্তু বাঙালির মাউন্ট এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার দিন অধরাই রয়ে গেল। অবশেষে, স্বপ্ন সার্থক হল ২০১০ সালের মে মাসের ভোরে প্রথম বাঙালি হিসেবে (অসামরিক) মাউন্ট এভারেস্টে পা রাখলেন বসন্ত সিংহরায় ও দেবব্রত বিশ্বাস। খবরটা পেয়েই বাঁধ ভাঙা আনন্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এই সাফল্যের কিছুটা কৃতিত্ব আমাদের ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালের দলটি দাবি করতেই পারে।

আমরা চূড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ভবিষ্যতে বাঙালিদের সফল মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের পথটা তো তৈরি করে দিয়েছিলাম।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BIVUJIT MUKHOTY BIVUJIT MUKHOTY

Pragramme Manager, The International Award for Young People. Mountaineer and member of first Mt. Everest Expedition team from Bengal.

Comment