ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ভাবনা রেলের, আমি কেন খুশি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের নিয়ম মোবাইল-ক্যামেরার যুগে একেবারেই বেমানান, অচলও

 |  5-minute read |   03-12-2018
  • Total Shares

শেষ ট্রেনে কোথাও যাচ্ছিলাম, সঙ্গে দিন কয়েক আগে কেন এসএলআর ক্যামেরা। ফাঁকা কামরায় জানলার ধারে বসে ক্যামেরায় চোখ রেখে লাইট-মিটারটা দেখছিলাম। আচমকাই ভারী গলায় ডাক -- দুই রেলপুলিশ মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে। ক্যামেরায় ছবি তুলছি কেন?

যদি দণ্ডবিধির আগে ডাণ্ডাবিধি প্রয়োগ করে, যদি ক্যামেরাটি যায়! গলা কাঠ। বুকের ফিতরটা শূন্য। সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। তখন অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন করতে পারিনি যে ক্যামেরায় ছবি তোলা ছাড়া আর কী করা যায়!

dsc_0202_120318071613.jpgভারতীয় জাদুঘরে দীর্ঘদিন এই বিজ্ঞপ্তিটি ছিল। ছবি তুলতে বাধা নেই, মোবাইল ফোনের কী অপরাধ? উত্তর কোনও দিনই পাওয়া যায়নি। 

বারাণসী থেকে রামগড়ে গেছি। গলায় অভিজ্ঞানের মতো ক্যামেরা। বারাণসীর নম্বরপ্লেট দেওয়া গাড়ি দেখে ক্যামেরায় হাত গেল... ফের ধরা পড়ে বিড়ম্বনার একশেষ। সেখানে ছবি তোলা নিষেধ, ছবি তুললে সম্ভবত ৫০০ টাকা জরিমানা। আমি জরিমানা দিতে রাজি হয়ে গেলাম। বিশ-পঞ্চাশ আদায় হচ্ছে না দেখে জাদুঘরের কর্মীটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

দু’টির কোনও ক্ষেত্রেই আমার কোনও দোষ ছিল না ছবিপ্রেমিক হিসাবে, তবে আইনের চোখে অবশ্য আমি দোষীই ছিলাম, কোনও সন্দেহ নেই। ২ ডিসেম্বর একটি সংবাদপত্রে দেখলাম, যে সব যাত্রীর কাছে ট্রেনের টিকিট আছে তিনি রেলের সম্পত্তির ছবি তুলতে পারবেন, তবে বাণিজ্যক প্রয়োজনে বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা যাবে না – এমন একটি প্রস্তাব রেলে জমা পড়েছে। খবরটি পড়ে বেশ উৎসাহী হলাম। এ বার অন্তত ট্রেনে এই সমস্যা হবে না। বিমানবন্দরে অবশ্য ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাধা নেই বহু দিনই।

asi_120318071840.jpgস্থিরচিত্র তুলতে গিয়ে আধঘণ্টা পরে ভিডিয়ো ফোটোগ্রাফির অনুমতি মেলে। কাউন্টারের কর্মীরা নিয়মটাই জানতেন না।

প্রশ্ন হল, কেন এই নিয়ম?

সাংবাদিকরা ছবি তুলে অনেক কিছু প্রকাশ করে দিতে পারেন বলে, মূলত তাঁদের ভয়েই বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে মানা। রামগরুড়ের ছানারা সদাই মরে ত্রাসে ওই বুঝি কেউ হাসে, তেমনই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিও সেই আশঙ্কাতেই থাকে। সাংবাদিক মানেই গোপন ক্যামেরায় ছবি তুলতে আসছে। কোথায় কী অনিয়ম তা প্রকাশ করে দেবে। আরও একটি যুক্তি প্রায়ই শুনতাম।

তখন আমি হায়দরাবাদে থাকি। কত বার যে সালার জঙ্গ মিউজিয়ামে গেছি জানি না। তবে একটি ছবিও নেই। ক্লোকরুমে ক্যামেরা জমা করে যেতে হত। এখন সেখানে ছবি তোলায় বাধা নেই, কিন্তু আমার আক্ষেপ রয়ে গেছে। যেমন সারনাথে যার লোভে গিয়েছিলাম সেই সারনাথ লায়ন ক্যাপিটালের (যার ছাপ টাকা-পয়সায় থাকে) ছবিটিই তোলা হল না। যে সব প্রতিষ্ঠান ছবি তুলতে দেয় না তাদের যুক্তি হল: জাদুঘরের এই সব সম্পদের ছবি যদি লোকে দেখে ফেলে তা হলে তারা আর দেখতে আসবে না, কারণ দেখা তো হয়েই গেছে!

museum-ticket_120318072019.jpgফেল কড়ি মাখ তেল, ছবি তোলার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই। তবে ভারতীয় জাদুঘরে এখন আর এই টিকিট নেই।

আমার যুক্তি হল, তাঁদের কথা যদি সত্যি হয় তা হলে তাজমহল, ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রভৃতি জায়গায় লোকে তো যাবেই না, সব ছবিই তো নেটের কল্যাণে হাতের মুঠোয়! বেশ কিছুদিন আগে এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্তের সঙ্গে, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি নিজেও ছবি তোলার উপরে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তার বিরুদ্ধে। এখন অবশ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ভিতরে ছবি তোলা যায়, কোনও বাধা নেই। মনে আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে কালীঘাটের পট নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ছবি তোলার জন্য দিল্লি থেকে (মন্ত্রক) অনুমতি নিতে হয়েছিল।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবশ্য আরেকটি নিয়মও চালু আছে, ছবি তুলতে হলে অনুমতি নিতে হবে টাকা দিয়ে। ভারতীয় জাদুঘরে ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য ৫০ টাকা দিয়ে অনুমতি নিতে হত। অথচ লোকে মোবাইল ফোনে দেদার ছবি তুলছে। তখন মোবাইল ফোনে ছবি তোলা নিষেধ ছিল। এখন সেই বাধা নেই। তবে মিশর বিথিকায় ছবি তোলা নিষেধ! আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থিরচিত্র তুলতে কোনও বাধা নেই, অনুমতিও নিতে হয় না কারও। বোট্যানিক্যাল গার্ডেনে অনুমতি প্রয়োজন।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পাটনা সার্কেলের একটি সংরক্ষিত ভগ্নাবশেষের ছবি তুলতে গিয়ে আরও জটিল অভিজ্ঞতা – সেখানে কর্মরত কেউ জানেনই না যে স্টিল ছবি তোলার জন্য অনুমোদন প্রয়োজন কিনা। আমি নিজেই উদ্যোগী হয়ে জানলাম যে কোনও অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও ভিডিয়োগ্রাফি করার জন্য যে অনুমোদন প্রয়োজন হয় সেটি নিতে হয়, তাতে আধ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। টাকাটি অবশ্য সামান্যই ছিল।

dsc_0392_120318072320.jpgআলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থিরচিত্রের জন্য অনুমতি দরকার হয় না।

প্রশ্ন হল রেল এই অনুমতি দেওয়ায় আমি খুশি কেন।

আমরা ট্রেনে করেই বেড়াতে যাই। অনামী ও অখ্যাত, আরও স্পষ্ট ভাবে বললে প্রায় গুরুত্বহীন স্টেশনে অনেক সময় নামফলক পিছনে রেখে ছবি তুলেছি। কিন্তু কোনও দিন হাওড়া স্টেশনের ভিতরে তেমন ছবি তুলতে পারিনি, কারণ সেটি বেআইনি। ছোট স্টশনে কেউ কোনও দিন বাধা দেননি, তাই ছবি তুলতে পেরেছি।

মোবাইল ক্যামেরার যুগেও আমরা এখনও সেই বিশ্বযুদ্ধের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যে কারণে সেতুর ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। ছবি দেখেই শত্রুরা চিহ্নিত করে ফেলবে জায়গাটি। তারা গুগলম্যাপ-রাডার ছেড়ে আপনার ফেসবুক ঘাঁটবে, অপেক্ষা করবে ততক্ষণে আপনি হাওড়া ব্রিজের ছবি আপলোড করবেন!

আজকাল সেলফি তোলা একরকম রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। চুনার দুর্গে বেড়াতে গিয়ে শুনলাম কুয়োর ধারে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ সেল্ফি তুলতে গিয়ে একজন মারা গেছেন। যিনি গেছেন তাঁকে আটকানো সম্ভব হয়নি, এখন আমাদের আটকানো কেন! চলন্ত ট্রেনে দরজার বাইরে ঝুঁকে সেল্ফি তুলতে গিয়ে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক ব্যক্তির, বছর দুয়েক আগে। রেল যদি ছবি তোলার অনুমতি দেয় তাহলে এই প্রবণতা বাড়বে না, যারা সেল্ফি তোলার তারা তুলছেই, এখনও তুলছে তখনও তুলবে। তবে আমার মতো কালেভদ্রে যারা বেড়াতে যায় এই নিয়ম চালু হলে তাদের অবশ্যই সুবিধা হবে।

rail1_120318072414.jpgরেল ছবি তোলার অনুমতি দিলে আমি খুশি হব (ছবি: রয়টার্স)

প্রতিটি রেল স্টেশনের এক একটা চরিত্র আছে। হাওড়া থেকে দক্ষিণপূর্ব রেলে পরপর কয়েকটি স্টেশনে নামুন। কয়েক কিলোমিটার করে পার্থক্য, কিন্তু যাত্রীদের ধরন, স্টেশনের চরিত্র কত আলাদা। ঝাড়খণ্ডের দেহাতি স্টেশনগুলিও অনবদ্য। নতুন নিয়ম চালু হলে সেই সব স্টেশনের ছবি তুলতে কোনও বাধা থাকবে না।

এই নিয়ম চালু হয়ে গেলে আমি তো প্রথমেই ক্যামেরা কাঁধে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাব!

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment