যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কনক সরকারের ঘটনা ব্যক্তি-মানস নয়, সমাজের প্রতিচ্ছবি
- Total Shares
আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কনক সরকার, যিনি এক সময় এই বিভাগের প্রধানও ছিলেন, গত ১৪ জানুয়ারি ফেসবুকে একটি মন্তব্য করেন নারীদের কুমারিত্ব নিয়ে।
এই মন্তব্যে মহিলাদের উনি সিল-করা পণ্যের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেছেন কোনও নারী যদি কুমারী না থেকে থাকেন তা হলে তাঁকে বিয়ে করা অর্থহীন। অর্থাৎ বিয়ের জন্য তাঁকে সিল-করা পণ্য হতে হবে। এমন মন্তব্য ফেসবুকে দেওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। আমি নিজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসাবে আমারও বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব ছাত্রীরা রয়েছি, যারা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ঘটনায় একত্রিত হয়ে আন্দোলন করেছি, তারাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করি যে উপাচার্যের কাছে আমরা স্মারকলিপি জমা দেব এ ব্যাপারে। সেই মতো আমরা স্মারকলিপি জমাও দিই।
কনক সরকারের সেই পোস্ট, যা তিনি মুছে ফেলেছেন (সৌজন্য: ফেসবুক)
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে কনক সরকার যখন ফেসবুকে একটি মন্তব্য করছেন তখন তাঁর যুক্তি, সংবিধানে ভাবপ্রকাশের অধিকার রয়েছে, তাই তাঁর বাক-স্বাধীনতা রয়েছে। সেই জায়গা থেকেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন। আমাদের বক্তব্যও স্পষ্ট। ছাত্রছাত্রী হিসাবে আমাদের মত হল – বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সমাজের চোখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাই তাঁর আলাদা একটি দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্বের জায়গা থেকে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি যে এই ধরনের ঘটনা এই প্রথমবার ঘটিয়েছেন তা নয়। এই নির্দিষ্ট ব্যক্তি এর আগে বহু বার শ্রেণীকক্ষের ভিতরে, শ্রেণীকক্ষের বাইরে, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ওঁর উপস্থিতি ছাত্রীদের বেশ অস্বস্তিতে ফেলে। ওঁর বিরুদ্ধে আগেও হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। তিনি নিজে পারিবারিক হিংসাতেও অভিযুক্ত। এই প্রতিটি বিষয়ই বিশ্ববিদ্যালের জানা ছিল, যদিও কোনও দিনই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
কনক সরকারের পুরেনো পোস্ট, সেখানেও লক্ষ্য নারীরাই। (সৌজন্য: ফেসবুক)
ফেসবুকে তাঁর এই অবমাননাকর মন্তব্যের পরে আমরা উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিই এবং ইন্টারন্যাল কমপ্লেন্স কমিটিতেও (আইসিসি)অভিযোগ জানাই। পরের দিন একটি বৈঠক ডাকা হয়। উপাচার্য বলেছিলেন যে, শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যের জন্য ওঁর পক্ষে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী।
পরের দিন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আবার দেখা করি। ওঁর ক্লাস করেছে এমন বহু ছাত্রীই বিভিন্ন সময়ে ওঁর মন্তব্যে অস্বস্তিতে পড়েছেন ও অপমানিত হয়েছেন। শ্রেণীকক্ষের মধ্যেই কখনও পোষাক নিয়ে, কখনও শরীর নিয়ে এমনকি শারীরিক গঠন ও যৌনপ্রবণতা নিয়েও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। নাম গোপন রেখে বিভিন্ন সময় উপাচার্যের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছিল। এ বার তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় ও অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির পক্ষ থেকে তিন মাসের জন্য সাসপেনশনে রাখার সিদ্ধান্ত হয়, তদন্তও শুরু হয়েছে।
এত দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের যত অভিযোগ আইসিসি-র কাছে জমা হয়েছে, তার প্রীতি ক্ষেত্রেই আইসিসির ভূমিকা নেতিবাচক ছিল। কোনও ক্ষেত্রেই হেনস্থার শিকার উপযুক্ত বিচার পাননি। তবে অধ্যাপক কনক সরকারের বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নড়েচড়ে বসেছে। তাদের এই অবস্থান আমাদের কাছে ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে। কারণ আমাদের ক্যাম্পাস এমন এক ক্যাম্পাস যা হোক কলরব আন্দোলনের সাক্ষী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানিকে কেন্দ্র করে। ছাত্রছাত্রীরাই এই আন্দোলন করেছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা। (ছবি সৌজন্য: মদনমোহন সামন্ত)
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও অধ্যাপক যখন কোনও মন্তব্য করেন তখন সেই মন্তব্য শুধুমাত্র তাঁর মন্তব্য থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে মহিলাদের ব্যাপারে তিনি তাঁর মতামত জানাচ্ছেন, মনোভাব প্রকাশ করছেন। তাঁর এই মনোভাব একজন ব্যক্তি হিসাবে নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন রকম আন্দোলন দেখেছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে তিনি যখন মহিলাদের প্রতি নিয়মিত ভাবে অবমাননাকর ও অপমানজনক মন্তব্য করতে থাকেন তখন তাঁর এই মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় যে এখনও সমাজ, কর্মক্ষেত্র এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মহিলারা কী অবস্থায় দাঁড়িয়ে।
এমন অনেক ছাত্রী আছেন যাঁদের ওঁর অধীনে গবেষণা করতে হয় এম.ফিলের জন্য। অনেক সময় কনক সরকারের চেম্বারেও যেতে হয় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সেই সব ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি কী চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে। ডিজার্টেশনের ক্ষেত্রেও ছাত্রীদের একই রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে একা ওই অধ্যাপকের ঘরে গিয়ে কথা বলতে ছাত্রীরা ভয় পাচ্ছেন।
এ থেকে বুঝতে হবে, একজন ব্যক্তি হিসাবে নয়, যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এই সমাজে রয়েছে সেই মানসিকতার চূড়ান্ত প্রতিমূর্তি হলেন কনক সরকার। তাঁর মতো ব্যক্তিরা, যাঁরা শিক্ষক হিসাবে সমাজের উপরের স্তরে থাকা মানুষের মধ্যে গণ্য হন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মহিলাদের এই ধরনের আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন এবং দিনের পর দিন তাঁদের অস্বস্তির মধ্যে রাখা এবং তাঁদের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন।
জেন্ডার সেনসেটাইজেশন কমিটি এগেনস্ট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নামে একটি কমিটি এতদিন থাকলেও, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাস থেকে এই দাবি উঠছে যে একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদল থাকুক এবং তারা দেখবে যে ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে কাউকেই শিক্ষকদের থেকে এই ধরনের বৈষম্য ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্বিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে লিঙ্গবৈষম্যহীন যে বৈশিষ্ট্য থাকার কথা, যাদবপুরেরও যেন সেই বৈশিষ্ট্য থাকে। কারণ, কনক সরকার কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কনক সরকারের মতো আরও অনেক অধ্যাপকই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন, তাঁদের নাম প্রকাশ্যে আসছে না, কারণ কোনও ভুক্তভোগী এগিয়ে আসছেন না। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের পদের ক্ষমতার অপব্যবহার এই ক্যাম্পাসে হয়ে থাকে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীরা। (ছবি সৌজন্য: মদনমোহন সামন্ত)
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক ও সাম্যের কথা বলে। আমাদের ধারনা যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাস করে না। তা সত্ত্বেও কনক সরকারের ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে একজন বারে বারে এই ধরনের ঘটনা ঘটালেও বিশ্ববিদ্যালয় কোনও পদক্ষেপ করছে না। আমরা মনে করি যে যাঁরা আমাদের শিক্ষাদান করছেন তাঁরা লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাস করেন কিনা বা এ ব্যাপারে তাঁদের অবস্থান কী, তা স্পষ্ট করতে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত।
এ বারের ঘটনায় অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি এবং চাইব যে পরবর্তী কালে ক্যাম্পাসে কোনও স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটলে (তার কারণ যাই হোক), কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।