শুধু দুর্ঘটনা ঘটলেই নয়, মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালালেই কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে

মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে অনমনীয় মনোভাব দেখায় মুম্বাই পুলিশ, সেই শিক্ষাই নিক কলকাতা

 |  4-minute read |   29-11-2018
  • Total Shares

মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর ফলে পথ দুর্ঘটনা শহরে যেন কমতেই চাইছে না।

২০১৬ সালে তৃণমূল নেতার ছেলে। গত বছর অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। এ বছর ফ্যাশান ডিজাইনার অদিতি আগারওয়াল। এই তিনটে ঘটনাই সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে কারণ এক্ষেত্রে গাড়ির চালকরা অপেক্ষাকৃত হাই-প্রোফাইল এবং এই তিনটে দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ মারা গিয়েছিলেন।

যেমন ২০১৬ সালে আম্বিয়া সোহরাবের গাড়ির ধাক্কায় মারা গিয়ে ছিলেন আইএফএ-এর এক জওয়ান। রেড রোডে কাকভোরে তিনি তখন রিপাবলিক ডের প্যারেডের অনুশীলন করছিলেন। গত বছর বিক্রম চট্টোপাধায়ের গাড়ি যখন লেক মলের সামনে ধাক্কা মারে তখন অভিনেতার পাশের আসনে বসে ছিলেন সোনাক্ষী চৌহান। দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এই সপ্তাহের শুরুতে ফ্যাশন ডিজাইনার অদিতি আগরওয়ালের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন এক বৃদ্ধ দিনমজুর।

এছাড়া, এই শহরে, আরও অনেক দুর্ঘটনার নিদর্শন রয়েছে যেখানে চালক মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও পুলিশের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যৎসামান্যই।

চালকরা মদ্যপান করেছেন কিনা তা সহজেই জেনে নেওয়া যায় ব্রিদ অ্যানালাইজার দিয়ে। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের কাছে এই যন্ত্র রয়েছেও। কিন্তু তার ব্যবহার খুব কম। গভীর রাতে কলকাতার কয়েকটি ক্রসিংয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টদের দেখা যায় এই যন্ত্র দিয়ে চালকদের পরীক্ষা করতে। তাও হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা ক্রসিংয়ে। তাও এমন ক্রসিংগুলোতে যার অধিকাংশের আশপাশে বার-কাম-রেস্তোরাঁর সংখ্যা নেহাতই কম। অর্থাৎ, যেখানে প্রয়োজন তার থেকে কিছুটা দূরেই এই যন্ত্র ব্যবহার করতে পছন্দ করে কলকাতা পুলিশ।

body1_112918013133.jpgপথ দুর্ঘটনা কমাতে মত্ত অবস্থার চালকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে [ছবি: পিটিআই]

এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নিজেই সেদিন বলছিলেন যে এর পরেও গভীর রাতের কলকাতায় প্রতি ১৫ জন চালককে পরীক্ষা করলে ছ' থেকে সাতজনকে অতি সহজেই ধরে ফেলা যায়। তার মানে ট্যাংরা (সামনেই চায়না টাউন), গড়িয়াহাট, ধর্মতলা বা বিবাদিবাগ চত্বরে বা পার্ক স্ট্রিটের মতো ক্রসিংগুলোতে এই পরীক্ষা করলে মত্ত চালকদের সংখ্যা অনেকটাই বাড়বে। কিন্তু সেই পথে হাটে না কলকাতা পুলিশ।

এবার উল্টো দিকে চালকদের কথায় আসি। যে সব চালকরা নিয়মিত মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালান তাঁরা নিশ্চিত যে দশবারের মধ্যে দশবার না হলেও তাঁরা মত্ত অবস্থায় পুলিশের চোখ এড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌছে যাবেন। কেন? তাঁদের রোজকার রাস্তায় কোথায় কোথায় পুলিশ গাড়ি পরীক্ষা করে তা তাঁদের কাছে ঠোঁটস্থ। সাবধানে সেই রাস্তাগুলো এড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরতে পারলেই পগারপার।

গত বছর বিক্রম চট্টোপাধ্যায় দুর্ঘটনার দিন তিনেক বাদে রাতের কলকাতায় বেরিয়ে ছিলাম। দেখতে চাইছিলাম পুলিশি ব্যবস্থা কতটা সক্রিয়, বিশেষ করে এই মোট অবস্থায় থাকা চালকদের ধরার ক্ষেত্রে। যা দেখলাম হতাশই হলাম। গড়িয়াহাট, পার্ক স্ট্রিট বা ট্যাংরার মতো এলাকাগুলোতে মত্ত চালক ধরার কোনও ব্যবস্থাই নেই। রাত সাড়ে এগারোটা - বারোটা নাগাদ এই চত্বরের বার-কাম-রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হয়। সেই সময়েই বেশিরভাগ লোক মদ্যপান করে এই রেস্তোরাঁগুলো থেকে বেরোন এবং অনেকেই নিজেরা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরেন।

অথচ, ব্যবস্থা থাকা তো দুরস্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সময়তে কোনও পুলিশ কেই রাস্তায় থাকতে দেখা গেল না। অনেক রাতে ধর্মতলার মুখে এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে দেখতে পেলাম ব্রিথ অ্যানালাইজার যন্ত্রটি নিয়ে দাঁড়িয়ে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনটে গাড়িকে আটকালেন সার্জেন্ট - একটি ট্যাক্সি আর দু'টি প্রাইভেট গাড়ি। পরীক্ষার ফল, ট্যাক্সি চালক ছাড়া বাকি দু'জনই মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

শহর ঘুরতে ঘুরতেই খবর এল বাইপাসের চিংড়িঘাটা ক্রসিংয়ের মোড়ে একটি গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। পৌঁছলাম দুর্ঘটনাস্থলে। পরীক্ষা না হলেও, চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল চালক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। দুর্ঘটনার স্থলে পৌছে মনে হল বুঝি শহরের সব পুলিশ এখানেই জমায়েত হয়েছে। ট্রাফিক গার্ডের ওসি সহ মোট পাঁচজন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনজন ট্রাফিক কনস্টেবলও ছিলেন। ট্রাফিক গার্ড দুর্ঘটনার স্থলের লাগোয়া। কিন্তু তাই বলে কয়েক কিলোমিটার দূরে বেলেঘাটা থানার পাঁচজন আধিকারিকও এখানে কী করছেন?

আসলে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করা নিয়ে কলকাতা পুলিশের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। মানে, মানসিকতা অন্যরকম। নাম কা ওয়াস্তে মামলা রুজু কর। অপেক্ষা কর দুর্ঘটনার জন্য। যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন তো চালক আর পালাবার পথ নেই।

body2_112918013316.jpgকলকাতা পুলিশের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে [ছবি: পিটিআই]

এই পরিস্থিতে মুম্বাই পুলিশের কাছ থেকে শিক্ষা নিক কলকাতা পুলিশ। প্রায় ১২ বছর আগে, ২০০৬ সালে, মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো নিয়ে 'জিরো টলারেন্স' পদক্ষেপ নিয়েছিল মুম্বাই পুলিশ। সেই বছর কার্টার রোডে দুই শিশু সহ মোট সাতজন পথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে চালক মত্ত অবস্থায় ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর হাজতবাসও হয়।

২০০৬ সালে ওই ঘটনার পর মুম্বাইয়ের মুখ হয়ে ওঠেন ট্রাফিক আধিকারিক হরিশ বজ্জল। কঠোর হাতে সে সময় তিনি মত্ত চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যা আজও মুম্বাইতে করা হয়ে থাকে। দুর্ঘটনা ঘটলে নয়, মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালালেই ব্যবস্থা নেয় মুম্বাই পুলিশ। আর পার্থক্যটা এখানেই।

দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশ অবশ্য এখন একটি নতুন পন্থা নিচ্ছে। মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট প্রয়োগ না করে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা প্রয়োগ করা হচ্ছে দোষী চালকদের বিরুদ্ধে। এতে দোষীদের সাজা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। কলকাতায় শেষ কয়েকটি ঘটে যাওয়া পথ দুর্ঘটনায় এই ধারা প্রয়োগ করে লাভ হয়েছে। দোষী চালকদের অপেক্ষাকৃত বড় সাজা হয়েছে। যেখানে, মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট প্রয়োগ করলে শুধুমাত্র ২০০০ টাকা জরিমানা দিয়েই জামিন পেয়ে যেত চালকরা।

সময় এসেছে নতুন চিন্তাভাবনার। শুধু মাত্র দুর্ঘটনা ঘটলেই কড়া ব্যবস্থা নয়। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালালেও কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে অনতিবিলম্বেই।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment