ঠেক থেকে সরাসরি: পুলওয়ামা নিয়ে লোকে কী বলছে

সারা দেশ পাকিস্তানের নিন্দায় মুখর, মনে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। থেমে নেই রাজনীতি

 |  5-minute read |   18-02-2019
  • Total Shares

ভেনু আর মেনু সেই একই। ভীমের চায়ের দোকানে সকাল বেলা।

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অমলদা। এখনও পুরোনো একটি ইংরেজি দৈনিকের গুটিকয় গ্রাহকের অন্যতম। সকলেই ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত। পুলওয়ামা নিয়ে সারা দেশ উদ্দীপ্ত, যাঁরা এই বাজারে তথাকথিত আঁতেল হতে গিয়েছিলেন তাঁদের নাকখত দিতে হয়েছে, সে সব ভিডিয়োও ঘুরছে বাজারে। ফস করে মন্তব্যটা করেই বসলেন অমলদা।

 “ওই আজহার মাসুদ তো ভারতের জেলে ছিল, পাকিস্তানে গেল কী করে?”

dscn9173_021819075055.jpgচায়ের আড্ডায়।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শ্যামলের জবাব, “কেন, ওই তো বিমান হাইজ্যাকের সময় বাজপেয়ী সরকার ছেড়ে দিয়েছিল।”

কানুদার সঙ্গে শ্যামলের নিত্য গোলমাল বাধে। মুখের সামনে থেকে খবরের কগজটা সরিয়ে একেবারে আঙুল তুলে কানুদা চেঁচিয়েই বলে উঠলেন: “বাজপেয়ীর সঙ্গে তখন তোমার দিদিও ছিল। তিনি তো বারন করতে পারতেন। করেননি কেন? আর এখন তোমাদের হয়ে যে কাগজটা সবচেয়ে বেশি তাঁবেদারি করছে, কদিন আগে তো ওরা অমলদার দলের হয়ে তাঁবেদাবি করত, কার্গিলের সময় তো নীতি দেখিয়ে যুদ্ধের খবর ছাপেনি, এখন এ সব ছাপছে কেন?”

অমলদার হজম হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তিনি সুর চড়িয়ে বললেন:  “দাঁড়ান-দাঁড়ান।” তারপরে চায়ের কাপে সশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন, “আগে বলুন ১৫ লাখ পেয়েছেন? কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ফিরেছেন? পাকিস্তান সবক শিখেছে?”

সঙ্গে শ্যামলের টিপ্পনি, “সরকার তো এখন ভোটের কথা ভাবছে!”

খবরের কাগটা লাঠির মতো করে পাকিয়ে হাতে নিয়ে অমলদা বললেন, “পনেরো লাখ টাকা তো ভোটের চমক ছিল, সিঙ্গুরের মতো। সেখানে শিল্প গেছে, কৃষি হয়নি। আর কাশ্মীরি পণ্ডিতরা কোথায় ফিরবেন? তাঁদের ঘর হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। না হয় যারা তাদের ঘরছাড়া করেছিল, তারা দখল করে রেখেছে। যারা ওপার বাংলা থেকে এসেছে তারা ঘরে ফিরতে পারবে? ব্যাপারটা সেই রকমই।”

pulwama-690-main_021819075242.jpgপুলওয়ামায় হামলার পরে। (ডেইলিও)

চায়ে চুমুক দেন কানুদা। টিকিয়ায় পোড়া বিস্কুটে কামড় দিয়ে শ্যামল বলল, “আর ওই পাকিস্তানের শিক্ষা পাওয়ার ব্যাপারটা? তখন তো বলেছিলেন, মানে আপনি বলেননি, ৫৬ ইঞ্চির সমর্থকরা বলেছিলেন যে তিনি এলে পাকিস্তান ভয় পাবে। এটা কি ভয় পেয়ে হামলা?”

ফের কানুদা: “না না, আগের ৭০ বছর কি করছিল সকলে? তখন দেশে সরকার ছিল না? এখন তো তবু মোস্ট ফেভার্ড নেশনের তকমা কেড়ে নেওয়া হল। আগের সরকার তো কাড়তে পারত সেই তকমা?”

অমলদার টিপ্পুনি, “বিজেপি সরকার তো আগেও ছিল, তখন তো তকমা কাড়তে পারত।” (শ্যামলের দিকে তাকিয়ে) “আর তোমরাও তো শরিক ছিলে বিভিন্ন সরকারে। পুলওয়ামায় হামলা কার অনুপ্রেরণায়?”

লালটু একটা লম্বা হোয়াটসঅ্যাপ কদিন ধরেই সকলকে পাঠাচ্ছে। তার শেষটায় লেখা ভারতে বসে ভারতকে গালাগালি দেওয়া কুকুরদের জন্য সমর্পিত। সেটা একটু আগেই পাঠিয়েছে এই দোকানের আড্ডার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। এ সবেরই মাঝে সেই মেসেজটা পড়ছিল সকলেই। ফোঁস করে উঠলেন অমলদা। তিনি বললেন, “এই সব মেসেজের মানে কী?”

লালটু যথারীতি অম্লান বদনে বলল, “যারা এ দেশে বসে এ দেশের সুযোগসুবিধা নিয়ে দেশের নিন্দা করে তাদের বলা হয়েছে, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?”

অমলদা বললেন, “কোনও সিরিয়াস আলোচনা হলেই তো তুমি ভুলভাল সব পাঠাতে থাক।”

লালটু মোবাইল ফোন থেকে চোখ না তুলে আরেক হাতে আধ খাওয়া ভাঁড় তুলে নিয়ে বলল – “ও, সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে বুঝি! বুঝতে পারিনি।”

অমলদা: “সারা দিনই তো মোবাইল ফোন ঘেঁটে চলেছ, পুলওয়ামায় কি হয়েছে জানো? সে সব জানার দরকার নেই! তবে কাল সন্ধ্যায় দেখলাম ক্লাব থেকে মোমবাতি নিয়ে মিছিল হয়েছে, তখন সামনের সারিতে উনি! ফালতু সব!”

লালটু এবার মুখ তুলল, “মোমবাতি নিয়ে মিছিল করব না তো লাল পতাকা নিয়ে মিছিল করব? পাকিস্তানকে যে সরকার মোস্ট ফেভার্ড নেশন তকমা দিয়েছিল সেই সরকারের শরিক তো আপনারা ছিলেন, ১৯৯৬ সালে কাদের সরকার ছিল দেশে? মাফ করবেন, আপনারা বাইরে থেকে সাপোর্ট করেছিলেন, হাতুড়ির বদলে ধানের শিস সরকারে ছিল, কাস্তেটা একই ছিল। পাকিস্তান কী এমন করেছিল ১৯৯৬ সালে যে ঘুমন্ত প্রধানমন্ত্রীর তাঁকে এত পছন্দ হল? পাকিস্তানের শিল্পী যখন দেশের কোথাও গাইতে পারছে না, তখন এ রাজ্যে ব্যবস্থা করা হল, কিসের অত দরদ? আর দেশের ইন্টেলিজেন্স কি ঘুমোচ্ছে?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো।

অমলদা আমতা আমতা করে: “না মানে দেশের এমন অবস্থায় রাজনীতি করা তো ঠিক নয়...”

লালটু ব্যাঙ্গাত্মক সুরে, “তাই যদি হবে, তা হলে সর্বদল বৈঠকে সব শোনার পরে উল্টো গাইলেন কেন শ্যামলের দিদির ভাইরা?”  

শেষ চুমুকটা দিয়ে ওঠার অভিপ্রায় করছিল শ্যামল। সে লালটুকে বড় একটা খোঁচায় না এই কারণেই। ও কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তবু শ্যামল বলল: “না, মানে যদি এই সুযোগে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভোট পিছিয়ে দেয় সরকার...”

“তা হলে কী হবে? তোর দিদির প্রধানমন্ত্রী হতে দেরি হয়ে যাবে? যুদ্ধ হলে তো হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে নয়!” লালটুর জবাব।

ফের অমলদা: “যুদ্ধ ছাড়া কি আর কিছু করার নেই?”

“থাকবে না কেন, অনেক কিছু আছে। সেগুলো করা চলছে। আপনাদের সরকারের দেওয়া প্রিয়-দেশের তকমা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আপনার কষ্টের কথা না ভেবে...” টিপ্পনি কানুদার। এতক্ষণে তাঁর দ্বিতীয় ভাঁড়টি খালি হয়ে গিয়েছে। লালটুর কথায় হালে পানি পেয়েছেন।

pulwama-2_021819075303.jpgপুলওয়ামায় হামলার পরে। (ডেইলিও)

মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠছিল লালটু, বাড়ি যাবে বলে...

চায়ের দোকানি ভীমদা বললেন, “আচ্ছা বাবু, মোদী হেরে গেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবে?”

সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের জবাব, “আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী বাছা হয় ভোটের পরে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো ভোট হয় না। বুঝলে ভীমদা।”

পকেটে মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে লালটু বলল, “ও, আচ্ছা। সেই ভাবেই তা হলে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বাজপেয়ী, মোদীকে ভোটের পরে সংসদ বেছে নিয়েছে?”

অমলদা বলেন, “জ্যোতি বসুর নামও ভোটের পরে ঠিক হয়েছিল, মনমোহন সিংয়ের নামও।”

লালটু হেসে বলে, “জ্যোতি বসুর দল ঐতিহাসিক ভুল করল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দিয়ে, আর মনমোহন সিং কোনও দিন ভোটে জিততে পারলেন না! কোনও দিন কোনও একটা লোকসভা কেন্দ্র তাঁকে নির্বাচিত করল না, তিনিই হলেন দেশের এক নম্বর প্রতিনিধি। বুঝলেন, সবটাই থিয়োরি... তত্ত্ব... ও সব কচলেই দিন কেটে যাচ্ছে। আর ওই যুদ্ধের অল্টার্নেটিভ বলছিলেন না, আপনাদের শ্রমিক-কৃষকের রাশিয়াও তো যুদ্ধ করেছিল, শুধু আত্মরক্ষার জন্য করেনি, সেটা নিশ্চয়ই জানেন। যাক, অফিসে যেতে হবে এবার।”

আগের সপ্তাহের আড্ডা

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment