বিশেষজ্ঞরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন, বিমান ভাড়া আবার আকাশে পৌঁছাবে
২০০৮ সালেও এই পরিস্থিতি হয়েছিল, আকাশ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল 'লো-কস্ট' ফ্লাইট
- Total Shares
২০০৮ সালের ঘটনা। বিমান সংস্থাগুলোর অবস্থা বেশ শোচনীয় ছিল। ক্যাপ্টেন গোপীনাথের কাছ থেকে এয়ার ডেক্যান কিনে নিয়েছিল কিংফিশার। অন্যদিকে, সুব্রত রয়ের থেকে এয়ার সাহারা কিনে নিয়েছিল জেট এয়ারওয়েজ। দেশের বিমান পরিবহন ব্যবস্থায় শুরু হল একটি নতুন শব্দ - 'মার্জদ এয়ারলাইনস'।
সেই সময় বিশেজ্ঞরা একটি আশঙ্কা করেছিলেন। আর, সেই আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত সত্যিই হল। 'লো-কস্ট' ক্যারিয়ার চিরকালের জন্য বিদায় নিল ভারতের আকাশ থেকে। তার বদলে বিমান পরিবহনে দু'ধরণের বিমানের আমদানি হল - 'ফ্রিল ক্যারিয়ার' ও 'নো-ফ্রিল ক্যারিয়ার'। এর মধ্যে ফ্রিল ক্যারিয়ার হচ্ছে সেই বীমানগুলো যেখানে আপনি খাবার ছাড়াও আরও বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা পাবেন। আর 'নো-ফ্রিল' ক্যারিয়ার মানে সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থা শুধুমাত্র আপনাকে গন্তব্যে পৌছিয়ে দেওয়ার জন্য টিকিট বেচছে।
এই 'নো-ফ্রিল' ক্যারিয়ারগুলো আদতে 'লো-কস্ট' ক্যারিয়ার ছিল। কিন্তু সেই সময় থেকে এই বিমানগুলোর ভাড়া অনেকটা বৃদ্ধি পেল। অর্থাৎ, পরিষেবা নয় চাহিদার উপর নির্ভর করে সমস্ত বিমানের ভাড়া নির্ণয় শুরু হয়ে গেল।
রুট বন্টন করে চাহিদা বৃদ্ধি
চাহিদার উপর নির্ভর করে যদি বিমানের ভাড়া নির্ণয় হয় সেক্ষেত্রে প্রথম কাজটি যেটা করতে হবে তা হল সকৌশলে চাহিদা বাড়িয়ে ফেলতে হবে। আর রুট বন্টনের (রুট রাশ্যনালাইজেশন) নামে চাহিদাও বৃদ্ধি করে ফেলল বিমান সংস্থাগুলো। 'মার্জদ এয়ারলাইন্স' -চালু হওয়ার ফলে বিমান সংস্থা (বিমান সংস্থার মালিকানার) সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। পড়ে থাকা বিমান সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে অলিখিত বোঝাপড়া করে এই রুট বন্টনের ব্যবস্থা করেছিল।
কী ভাবে হয়েছিল এই রুট বন্টন?
ধরুন 'এ' ও 'বি' দুটি জায়গার মধ্যে দিনে তিনটি বিমান সংস্থা ১০০-আসন বিশিষ্ট তিনটি বিমান চালাত। অর্থাৎ, এই সেক্টরের জন্য দিনে ৩০০টি আসন ছিল। হিসেবে করে দেখা গেল যে ওই সেক্টরে গড়ে ২২০ থেকে ২৫০ জন মতো যাত্রী হচ্ছে। তার মানে, তিনটি বিমান মিলিয়ে গড়ে ৫০ থেকে ৮০টি আসন ফাঁকা যাচ্ছে। অলিখিত বোঝাপড়ার মাধ্যমে, এর পর একটি বিমান সংস্থা ওই সেক্টর থেকে নিজেদের বিমান প্রত্যাহার করে ফেলল।
ভারতের আকাশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে লো-কস্ট বিমান [ছবি: পিটিআই]
হিসেবটা কী দাঁড়াল? গড়ে ২২০ থেকে ২৫০ জন যাত্রীর জন্য আসন সংখ্যা নেমে এল দু'শোতে। মানে, চাহিদা বাড়ল। ফলে বিমান ভাড়াও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল।
অনেকেই হয়ত প্রশ্ন করবেন যে এর মধ্যে বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে বোঝাপড়াটা কোথায়? যে বিমান সংস্থা এই সেক্টর থেকে বিমান প্রত্যাহার করল সে ই ব্যবস্থার সুবিধাভোগ করল অন্য একটি সেক্টরে। কারণ সেই সেক্টরে অন্য একটি সংস্থা নিজেদের বিমানটি প্রত্যাহার করে ফেলল।
দুই, মার্জদ এয়ারলাইন্সগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেল তারা বেশি সংখ্যক 'ফ্রিল' বীমানগুলো প্রত্যাহার করল। যেমন জেট এয়ারওয়েজ সে সময় সাহারার বিমান (প্যার নামকরণ হয়েছিল জেটলাইট) যত বেশি প্রত্যাহার করেছিল তার চাইতে ঢের বেশি জেট এয়ারওয়েজের বিমান প্রত্যাহার করেছিল। কিংফিশারও ডেক্যানের (কিংফিশার রেড) থেকে নিজেদের বিমান অনেক বেশি প্রত্যাহার করেছিল। ফলে তথাকথিত 'লো-কস্ট' বা 'নো-ফ্রিল' বিমানের ভাড়া আকাশ ছুঁয়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতি
বিমান সংস্থাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি বেশ শোচনীয়। ইন্টারগ্লোব অ্যাভিয়েশন লিমিটেড (যে সংস্থাটি ইন্ডিগোর বিমান চালায়) এ বছর সবচাইতে বেশি লোকসান করেছে। এবছর ইন্ডিগোর প্রি-ট্যাক্স লাভের পরিমাণ প্রায় ৫২ শতাংশ কমেছে। একটি অবস্থা জেট যাদের প্রি-ট্যাক্স লাভের পরিমাণ ৩,৪১১ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে এবং স্পাইস জেটের যাদের প্রি-ট্যাক্স লাভের পরিমাণ এ বছর ১,০০৩ কোটি টাকা কমেছে।
এই পরিস্থিতিতে আবার বিমান সংস্থাগুলো নিজেদের স্টেক বেঁচে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। খবরের প্রকাশ, জেটের স্টেক কেনার ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়েছে টাটা সন্স।
এদেশে বিমান শিল্পে ইতিমধ্যেই ইতিমধ্যেই টাটা সংস্থার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে জোট বেঁধে 'ফ্রিল ক্যারিয়ার' ভিস্তারা চালায় এই সংস্থা। আবার এয়ার এশিয়া ইন্ডিয়ার মতো 'নো-ফ্রিল' ক্যারিয়ারেও স্টেক রয়েছে টাটার।
পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে বছর দশেক বাদে আবার নতুন করে এয়ারলাইনগুলোর মার্জার হতে চলেছে। এবং মালিকানার সংখ্যা কমতে চলেছে।
বিমান ভাড়া আবার আকাশে পৌঁছাবে [ছবি: পিটিআই]
আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা আবার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। এই ভাবে চললে আবার নতুন করে রুট বন্টন শুরু হবে। অর্থাৎ, বিমান ভাড়া আবার আকাশে পৌঁছাবে।
এক নামকরা ভ্রমণ সংস্থার মালিক সেদিন বলছিলেন স্পাইস জেটের কলকাতা পেকিয়ং বিমানটির কথা। ২,০০০ টাকার প্রারম্ভিক ভাড়া থেকে শুরু মাসখানেকের মধ্যে বিমানের ভাড়া ১০,০০০ টাকা হয়ে গিয়েছে। বিশেষ বিশেষ দিনে তা ১৪ কিংবা ১৫ হাজার ছুঁয়ে ফেলে।
ভদ্রলোক ব্যাখ্যা করলেন, এই বিমানটির চাহিদা তুঙ্গে। চাহিদা বেশি মানে অন্য বিমান সংস্থা কিন্তু এই সেক্টরে বিমান চালানোর কথা চিন্তা ভাবনা করতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও সংস্থাই আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তাঁর কথায়, "হিসেবটা পরিষ্কার - স্পাইস জেট এখানে 'করে খাক', আমি অন্য সেক্টরে বেশি ভাড়া দিয়ে টিকিট বেচব। লক্ষ করে দেখবেন ভিস্তারা যেসব সেক্টরে বিমান চালু করেছে তার মধ্যে অনেকগুলোতে জেট নিজেদের বিমান প্রত্যাহার করেছে। আবার, উল্টোটাও হয়েছে। বেশি কিছু লাভজনক সেক্টরে ভিস্তারা কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছে না।"
ফের বিমান ভাড়া বৃদ্বির যাত্রাটা কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু টেকঅফের অপেক্ষা।