অদৃষ্টের পরিহাস: বাল ঠাকরের ভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদিক্কি

রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে বলিউড তারকাদের জবুথুবু হয়ে থাকা দেখতেই আমরা অভ্যস্ত

 |  5-minute read |   25-12-2017
  • Total Shares

মুসলিম হয়েও গ্রামের রামলীলা অনুষ্ঠানে অভিনয় করবার জন্যে শিবসেনার ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন নওয়াজউদ্দিন সিদিক্কি। অদৃষ্টের কী পরিহাস! এবার সেই নওয়াজউদ্দিনকে শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের বায়োপিকে একেবারে বাল ঠাকরের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যাবে।

২০১২ সালে প্রয়াত হন বাল ঠাকরে। আসমুদ্রহিমাচলে মুসলমান-বিদ্বেষী বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ এর মুম্বাই দাঙ্গার পর শ্রীকৃষ্ণ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী শিবসেনার বহু সদস্যই সেই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দাঙ্গায় ন'শোর বেশি লোক মারা গিয়েছিল।

body_122517042054.jpg

একজন অভিনেতা তাঁর পছন্দ মতো যে কোনও চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারেন। কিন্তু রামলীলা করতে চেয়ে শিবসেনার ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন নওয়াজউদ্দিন, এবার বাল ঠাকরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে নওয়াজ একটি ভিডিও বার্তা পাঠান: আমার জীবনের অন্যতম খুশির দিন। আমি খুশি যে এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় আমি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বের যে কোনো অভিনেতাই ওঁর ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেলে গর্ব বোধ করতেন। আমি জানি বালাসাহেব আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাবেন এবং আশীর্বাদ করবেন।

নওয়াজউদ্দিন একটি টুইটও করেন: দেশের একজন সত্যিকারের রাজার ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরে আমি গর্বিত। বাল ঠাকরের ছেলে উদ্ধব ও সঞ্জয় রাউতের মত বর্ষীয়ান শিবসেনা নেতাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন নওয়াজউদ্দিন।

নওয়াজউদ্দিনের টুইটের উত্তরে একজন লিখেছেন: "বাল ঠাকরে সারা জীবন দুঃখ করে গেছেন যে উত্তরপ্রদেশের লোকেরা মুম্বাইতে এসে মারাঠিদের কাজ খেয়ে ফেলছেন। অথচ আজ সেই উত্তরপ্রদেশ থেকে মুম্বাইতে এসে একজন তাঁর ভূমিকায় পর্দায় অভিনয় করতে চলেছেন।"

অমিতাভ বচ্চনও নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন, "বালাসাহেব ঠাকরের সঙ্গে আমার খুব ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বালাসাহেব কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতাম। উনি আমার কাছে পিতৃতুল্য ছিলেন।"

বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র নরেন্দ্র মোদীকে দেশের জনক হিসেবে আখ্যা দিতেই পারেন। কিন্তু একজন মহাতারকা - যিনি তিন তিনটে প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন - তিনি যদি কাউকে পিতৃতুল্য বলে সম্বোধন করেন তা হলে তার মাপকাঠি একেবারেই আলাদা। ঠাকরে আর অমিতাভের মধ্যে বয়েসের কিন্তু খুব একটা ফারাক নেই।তবে অমিতাভ ও ঠাকরের এই ঘনিষ্ট সম্পর্ক, ব্যতিক্রমী কোনও ব্যাপার নয়।

সুনীল দত্তের মত মহাতারকা কংগ্রেসের সাংসদ হয়েও ঠাকরের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন।সুনীল দত্তের ছেলে যখন বেআইনি অস্ত্র মামলায় জেলে ছিলেন তখনও প্রায়শই তিনি ঠাকরের বাসভবনে যেতেন। সঞ্জয় দত্তের মুক্তির জন্য ব্যক্তিগত ভাবে কংগ্রেস নেতা নরসিমহা রাওকেও ফোন করেছিলেন ঠাকরে। আসলে মুম্বাইয়ের সিনেমা জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল ঠাকরের। সিনেমা জগতের প্রত্যেকের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল ঠাকরের এবং প্রয়োজনে তাদের নিরাপত্তা দিতেও কখনও পিছপা হননি শিবসেনা নেতা।

body1_122517042633.jpg

তবে এর মধ্যেও কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল। যেমন একে হাঙ্গালকে কেন্দ্র করে। ৯৩তে পাকিস্তানে নিজের জন্মভিটে দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করে সে দেশের ভিসার জন্যে আবেদন করেছিলেন হাঙ্গাল। মুম্বাইতে পাকিস্তানের দূতাবাসে পাকিস্তান দিবসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হাঙ্গালকে। এর পরেই শিবসেনার রোষের শিকার হন হাঙ্গাল। তাঁকে বিশ্বাসঘাতকের তকমা দিয়ে ফেলেন ঠাকরে।

হাঙ্গালের সিনেমাগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং মুম্বাই জুড়ে তাঁর কুশপুতুলও পোড়ানো হয়। তবে ঠাকরের কাছে নতি স্বীকার করেননি হাঙ্গাল। হাঙ্গালের মতো আর একজনও আছেন যিনি ঠাকরের ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। তিনি দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল ঠাকরের এবং দিলীপ কুমার একবার বলেছিলেন, 'বালসাহেব শুধু বাঘ নন, তিনি সিংহ।' কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে যায় ৯৯এর কার্গিল যুদ্ধের সময়। ঠাকরের নির্দেশ মেনে পাকিস্তানেই সর্বোচ্চ সম্মান নিশান-ই-পাকিস্তান ফেরত দিতে অস্বীকার করেন দিলীপ কুমার।

এমনিতেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে বলিউড তারকাদের জবুথুবু হয়ে বসে থাকা দেখতেই আমরা বেশি অভ্যস্ত।

১৯৭৬ সালে তখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সঞ্জয় গান্ধীর প্রচারের জন্য একটি সঙ্গীত সন্ধ্যা আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে মুম্বাইয়ের কোনও তারকাই উপস্থিত না থাকার সাহস দেখতে পারেননি। সবাই এসেছিলেন। এমনকি আর ডি বর্মন ও দিলীপ কুমারও। একমাত্র ব্যতিক্রমী ছিলেন কিশোর কুমার। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, "আমাকে টাকা দিন। আমি নিশ্চয়ই যাব।"

নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখার মাসুল গুনতে হয়েছিল কিশোর কুমারকে। ক্ষিপ্ত সঞ্জয় গান্ধী দূরদর্শন ও আকাশবাণীতে কিশোর কুমারের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেন। এর পর বেশ কয়েকজন প্রযোজকের অক্লান্ত অনুরোধের পর সেই নিষেধাজ্ঞা তোলা হয়।

১৯৮৫তে প্রীতীশ নন্দীকে কিশোর কুমার বলেছিলেন, "আমি যেটা করতে চাই না সেই কাজ কেউই জোর করে আমাকে দিয়ে করাতে পারবে না। আমি কারও ইচ্ছে বা নির্দেশে গান গাই না।"

বিনোদন জগতে মোটা অঙ্কের টাকার খেলা চলে। তাই রাজনৈতিক নেতারা বিনোদন জগতকে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ব্যবহার করেন। এই সম্পর্কগুলো কখনও বাধ্যতামূলক হয় আবার কখনও লোক দেখানোও হয়। সংবাদমাধ্যমও এই সম্পর্কগুলো থেকে নিজেদের মতো ফায়দা তোলে।

body2_122517042701.jpg

আঞ্চলিক দলগুলোও নিজেদের প্রচারের আলোয় আনতে চায়। কর্নি সেনাকেই দেখুন। কী ভাবে সঞ্জয় লীলা বনশালির পদ্মাবতী নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে প্রচারের আলোয় চলে এল। অন্যদিকে, বিরুষ্কার ইতালিতে বিবাহ করা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে মধ্যপ্রদেশের এক তৃণমূল স্তরের রাজনৈতিক নেতা প্রচারে আসতে চাইলেন।

নিজেদের লাভবান করে তুলতে বা স্বার্থসিদ্ধি করতে রুপোলি পর্দার তারকা থেকে রাজনৈতিক নেতা, ধর্মগুরু থেকে সংবাদমাধ্যম সকলেই সিদ্ধহস্ত। এরা প্রত্যেকেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চান।

নোটবন্দির সময় দেখুন। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, যাঁদের দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই, তারাই সরকারি সিদ্ধান্তের বন্দনায় মেতে উঠলেন।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮১তে মুক্তি পাওয়া মেফিস্টো সিনেমাটির কথা মনে পড়ল। হিটলারের জার্মানিতে হেনড্রিক হফগেন নামের জনৈক অভিনেতার গল্প দেখান হয়েছিল এই সিনেমায়। নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতে নাত্সি পার্টির কাছে নিজেকে একেবারে বিকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সমস্ত নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে।

এ দেশে তো হফগেনদের ছড়াছড়ি। চেতন ভগৎ রয়েছেন। শুভাপ্রসন্নর মত শিল্পী রয়েছেন যিনি সর্বদাই মমতা-বন্দনায় মুখর। সর্বোপরি এঁদেরকে জনপ্রিয় করে তোলবার জন্যে সংবাদপত্রের 'পেজ থ্রি'  তো রয়েছেই।

এই পরিস্থিতিতে আমজনতার হাল কী, যাদের হাতেই রয়েছে গণতন্ত্রের জিয়নকাঠি? আমরা শুধু শুনেই যাব তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ক্ষোভ উজাড় করে দেব। অন্যদিকে, 'মন্দের ভালোরা' সিংহাসন আলোকিত করে রাখবেন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

GAUTAM BENEGAL GAUTAM BENEGAL @gautambenegal

Award winning animation filmmaker, artist, author, and social commentator.

Comment