জলদস্যুদের থেকে নিস্তার দিতে ব্যর্থ সোমালিয়া সরকার, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে ভারতকে

জমিয়ে নিরাপত্তা রক্ষী সরবারহের ব্যবসা করে চলেছে শ্রীলঙ্কা, বাড়ছে পণ্যের দাম

 |  3-minute read |   02-12-2018
  • Total Shares

আফ্রিকার উপকূলে সোমালিয়া নামের ছোট্ট একটি দেশের অস্তিত্ব না থাকলে নাবিকদের জীবনে হয়তো এতটা আতঙ্ক থাকত না। ভারত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই ছোট্ট দেশটি - যার জনসখ্যাও অত্যন্ত নগণ্য - আইডেন উপসাগর ও সুয়েজ খালের মধ্যবর্তী অঞ্চলটির মধ্যে জাহাজ চলাচলের সংজ্ঞাটাই যেন বদলে দিয়েছে।

'জলদস্যু' - যে শব্দটি নাবিকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট - তা একান্তভাবে 'মেড ইন সোমালিয়া' পণ্য।

শুরুতেই সোমালিয়া সম্পর্কিত কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের দেশের তৈরি হওয়া বর্জ্য পদার্থ এনে এ দেশে ফেলে যেত। অর্থাৎ, সোমালিয়াকে 'ভাগাড়' হিসেবে ব্যবহার করত। এর ফলে এই দেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল।

দীর্ঘদিন মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দেশের তরুণ প্রজন্ম একবার বদলা নিতে উদ্যত হয়েছিল। তাঁরা তাদের উপকূল লাগোয়া সমুদ্রপথ ব্যবহার করা জাহাজগুলোকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা বেশ ভালোভাবেই জানতেন যে প্রায় গোটা বিশ্বের কাছেই এই সমুদ্রপথটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আদ্যিকালের একে-৪৭ ও রকেট লঞ্চার বেআইনি পথে আমদানি করে তাঁরা জাহাজ অপহরণ শুরু করে দিলেন।

অচিরেই তাঁদের 'ব্যবসা' ফুলেফেঁপে উঠল। নাবিকদের আতঙ্ক বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল তাদের ব্যবসার পরিধি ও পরিমাণ। একটা সময়ে বড় জাহাজের নাবিকদের অপহরণ করে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ কোটি টাকা) মুক্তিপণ চাওয়া হত।

জাহাজের সংস্থাগুলোর ব্যবসা প্রায় লাটে উঠতে বসেছিল সে সময়ে। সংস্থার তরফ থেকে বেশি টাকার মাইনের প্রলোভন দিয়েও কোনও লাভ হত না। নাবিকরা ওই জলপথ ব্যবহার করা জাহাজগুলোতে চাকরি করতে রাজি হতেন না। এই জলপথে জাহাজের সংখ্যা কমল। আর তাতে হিতে বিপরীত হল। সোমালিয়ার জলদস্যুরা অপহরণ করার জন্য আরও মরিয়া হয়ে উঠলেন।

body_120218060519.jpgনাবিকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সোমালিয়ার জলদস্যুরা [ছবি: রয়টার্স]

একটা সময় এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে জাহাজগুলো একত্রে একটি কনভয় করে চলাচল করা শুরু করল। কিন্তু তাতেও লাভের লাভ কিছুই হল না। ১০-১২ টি জাহাজের কনভয় গেলেও তারা আক্রমণ করতে শুরু করল। মূলত কনভয়ের শেষের দিকের জাহাজগুলো তাদের আক্রমণের শিকার হত। আটকাবার কোনও উপায় ছিল না নাবিকদের কাছে। নিয়মানুযায়ী মার্চেন্ট নেভির জাহাজে সশস্ত্র কাউকে রাখা যাবে না।

এই পরিস্থিতিতে সোমালিয়া সরকারের উচিত ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সোমালিয়া সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশি উৎসাহিত হল না। ফলে যে দেশের জাহাজ সে দেশের সরকারের উপর নিরাপত্তার দায়িত্ব এসে পড়ল।

বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নৌবাহিনী এই এলাকাগুলোতে তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু অন্যদেশের জলসীমায় যতটা পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হল তাতে জলদস্যুদের উৎপাত আটকানো সম্ভব হল না। বিশেষ করে ভারতীয় জাহাজগুলো তো কোনও মতেই আতঙ্কমুক্ত হল না।

এই পরিস্থিতিতে নতুন একটি ব্যবসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মার্চেন্ট নেভির আইনে সামান্য রদবদল করে বলা হল যে এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচলের সময়ের স্বসস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নেওয়া যাবে। ব্যাস! চুটিয়ে নিরাপত্তারক্ষী জোগান দেওয়ার ব্যবসা শুরু হয়ে গেল শ্রীলঙ্কায়।

এখন প্রতিটি জাহাজ এই অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময় তিনদিনের জন্য তিনজন নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করে। বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী বা অন্য নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা এই নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। এদের পিছনে বেশ মোটা টাকা খরচ করতে হয় জাহাজ কোম্পানিগুলোকে। দিনে একেকজন নিরাপত্তারক্ষী প্রতি ৩০০০ ডলার মতো খরচ হয়। অর্থাৎ, তিনদিনে তিনজনের জন্য ২৭,০০০ ডলার মতো।

একবার বুঝে দেখুন এই ব্যবসার টার্নওভার কত। একটা ছোট তথ্য এই ফাঁকে দিয়ে রাখি। খুব খারাপ সময়তেও প্রতি দিন কম করে তিরিশটি করে জাহাজ এই অঞ্চল দিয়ে চলাচল করে থাকে।

ব্যক্তিগত ভাবে একজন নাবিক হিসেবে আমার মনে হয় এই ব্যবসাকে বাড়তে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। উল্টে সোমালিয়ার জলদস্যুদের তাণ্ডব কী ভাবে কমানো যায় সে দিকে নজর দেওয়া হোক। সোমালিয়ার সরকার যদি তা না পারে তা হলে যে দেশের জাহাজ সেই দেশের সরকারকেই নাবিকদের সুরক্ষা দায়িত্ব নিতে হবে।

এ শুধু নাবিকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া হয়, পনি পরিবহণের খরচও অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার প্রভাব পণ্যের খোলা বাজারে পড়তে বাধ্য। কিছুদিন বিষয়টি নিয়ে ক্যাপ্টেন ফিলিপ্স নামের একটি অসাধারণ ইংরেজি সিনেমাও মুক্তি পেয়েছিল।

আরও একটি হলিউড সিনেমার কথা এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল - পাইরেটস অফ ক্যারিবিয়া। আশা করব একদিন ব্রায়ান লারার দেশের জলদস্যুদের মতো সোমালিয়ার জলদস্যুরাও শুধুমাত্র 'রিল লাইফে' ধরা দেবে। রিয়্যাল লাইফে নয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TONMOY CHATTERJEE TONMOY CHATTERJEE

The writer is a former merchant navy officer.

Comment