কতটা চাপ ছিল উর্জিতের উপরে, স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবেন শক্তিকান্ত?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হয়েছেন একাধিক আমলা, তবে এমন অস্বস্তিকর প্রশ্ন ওঠেনি

 |  6-minute read |   13-12-2018
  • Total Shares

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হলেন শক্তিকান্ত দাস। অর্থ বিষয়ক সচিবের দায়িত্ব সামলানো শক্তিকান্ত দাসকে যে বিজেপি সরকার এই পদে বসিয়েছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। মনমোহন সিং, বিমল জালানের মতো একাধিক সচিব (যাঁরা অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) এই পদে বসেছেন। তবে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাতন্ত্র্য তাঁরা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন এবং দেখা গেছে তাঁরা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার স্বার্থে ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ করছেন।

shakti_121318013738.jpgভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন গভর্নর শক্তিকান্ত দাস (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

আইআইটি (খড়্গপুর), ওহোয়ো স্টেট ইউনির্ভাসিটি এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির প্রাক্তনী দুব্বুরি সুব্বারাও তো অর্থমন্ত্রকের সচিব থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হয়েছিলেন। অর্থনীতিতে পিএইচডি সুব্বারাও সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘাতে গিয়েছিলেন। পদত্যাগ করার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল কিনা জানি না, তবে পদত্যাগ করেননি।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে রঘুরাম রাজনকেও এই পথে চলতে দেখা গেছে, সরকারের নীতি সমর্থন করেননি, পদত্যাগও করেননি, তিনি অবশ্য মনমোহন সিং, বিমল জালান ও সুব্বারাওয়ের মতো প্রাক্তন আমলা নন।

সরকারি ভাবে ব্যক্তিগত কারণের কথা বলে পদত্যাগ করলেও উর্জিত প্যাটেলের সঙ্গে অর্থমন্ত্রকের যে সংঘাত চলছিল তা স্পষ্ট হয়েছে বারে বারে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী নিজের পদত্যাগপত্রে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাননি উর্জিত। এটি আবশ্যিক নয়, তবে রীতি তো অবশ্যই।

কার্যকাল শেষ হওয়ার ন-মাস আগে এ ভাবে পদত্যাগ দেশের পক্ষে শুভ লক্ষণ তো নয়ই, সরকারের দিক থেকেও অস্বস্তির কারণ।

কেন তিনি পদত্যাগ করলেন সে ব্যাপারে সরকার যে কোনও মন্তব্য করবে না সেটাই স্বাভাবিক। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সেই রুটিন প্রতিক্রিয়াই পাওয়া গেছে। যদিও পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগের দিন বলে এ নিয়ে তেমন উচ্চকণ্ঠে আলোচনা শোনা যায়নি।

বেশ কিছুদিন ধরেই একটা কথা শোনা যাচ্ছিল যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৪-এর ৭(১) ধারা প্রয়োগ করতে পারে সরকার। এই ধারা প্রয়োগ করা নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মধ্যে। এই ধারা অনুযায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করার পরে জনস্বার্থে তাঁকে কোনও নির্দেশ দিতে পারে সরকার। “সরকার নির্দেশ দিতে পারে” মানে হল, সরকারি নীতি অনুযায়ী চলার জন্য নিয়ামক ব্যাঙ্ককে বাধ্য করতে পারে। আইন মেনেই সরকার এই কাজ করতে পারে, তবে তা দেশের পক্ষে যে মঙ্গলজনক নয়, তা বোঝাই যায়। সরকারের মাথায় নির্বাচনে জয়ের চিন্তা থাকতে পারে, মনমোহিনী নীতিও সেই কারণে সরকার নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু ভারতী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভোটে জেতার দায় নেই, তাই দেশের অর্থনীতির পক্ষে ভালো এমন সিদ্ধান্তই তারা ঘোষণা করে।

উর্জিত প্যাটেলের সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সরকারের বেশ কয়েকটি চিঠি থাকতে পারে। শক্তি উৎপাদক সংস্থাগুলিকে বেশ কয়েকটি ছাড় দেওয়ার কথা জানিয়ে সরকার চিঠি দিয়েছিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে যে গচ্ছিত অর্থ রয়েছে তা দিয়ে সরকারি বন্ড কেনা নিয়ে গভর্নরের মতামতও জানতে চেয়েছিল। এর পরেই ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ৭(১) ধারা প্রয়োগের কথা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে এবং সরকার সাফাই দেয় যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাদের কোনও মতবিরোধ নেই।

rbi_body_121318012902.jpg নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত পছন্ত ছিল না বলেই নাকি কার্যকাল বাড়ানো হয়নি রঘুরাম রাজনের (বাঁদিকে), এ বার আচমকাই পদত্যাগ করলেন উর্জিত প্যাটেল। (ছবি: রয়টার্স)

২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের দায়িত্ব নেন উর্জিত প্যাটেল। সে বছরই বিমুদ্রাকরণ করে সরকার। বিমুদ্রাকরণের কয়েকদিনের মধ্যেই প্রথম বার ২০০০ টাকার নোট বাজারে আসে। প্রশ্ন হল, কালো টাকা রোধে ও বড় অঙ্কের লেনদেন নগদে করার বিপক্ষেই যদি সরকার থাকে, তা হলে কেন ২০০০ টাকার নোট বাজারে আসবে? সেই উত্তর অজানা।

তা ছাড়া মোট নগদের অঙ্কের ৮৬ শতাংশ বাতিল হওয়ায় ও সরকারকে বাজারে বিপুল পরিমাণে নোট ছাড়তে হয়। তাতে দেশকে বিপুল আর্থিক ধাক্কা সামলাতে হয়। অনেকেই বলেন যে সরকারের এই প্রস্তাবে তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজন রাজি না হওয়ায় তাঁর কার্যকাল বাড়ানো হয়নি।

প্রত্যেক তিন মাস অন্তর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক নীতি নির্ধারণ করে। ২০০৭ সালে প্রথম ত্রৈমাসিক শেষে পরের ত্রৈমাসিকের জন্য নীতি ঘোষণার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের তকালীন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মনিয়মের সঙ্গে দেখা করার কথা বলা হলেও তা উর্জিত করেননি বলে সংবাদমাধ্যমের খবর। চাপা সংঘাতের প্রকাশ তখনই। এর পরে দু’বার বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে উর্জিত প্যাটেলের। তবে সংঘাত চরমে ওঠে এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারি যখন সব ধরনের ঋণ পুনর্গঠনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কারণ ব্যাঙ্কের হাতে এখন দেউলিয়া আইন রয়েছে।

কেন এই সিদ্ধান্ত? কেউ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাঙ্ক তার সঙ্গে নানা ভাবে দরকষাকষি করে সেই ঋণের টাকা আদায়ের চেষ্টা করে এবং মেয়াদ বাড়িয়ে, ছাড় দিয়ে, এমনকি ঋণ পরিশোধ দেখিয়ে নতুন করে ঋণও দেখাতে পারে। কিন্তু ঋণের টাকা পরিশোধে একদিন দেরি হলেই সেই অঙ্ককে অনাদায়ী ঋণ দেখালে খাতায়-কলমে ব্যাঙ্কের লোকসান কম থাকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা চাইছিল না।

পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের আর্থিক জালিয়াতি প্রকাশ্যে আসার পরে সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘাড়ে দায় চাপাতে চাইলে তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরে বেহাল অর্থনীতি চাঙ্গা করতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ৫০,০০০ কোটি চেয়ে বসে কেন্দ্রীয় সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাতেও রাজি হয়নি।

এর পরে আরও কঠিন চাপে পড়ল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এ বার ঋণ শোধ করতে পারল না আইএল অ্যান্ড এফএস-এর মতো সংস্থা, তাতে ননব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কিনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে চাপ দিতে থাকে কেন্দ্র।

তারপরে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড থেকে নচিকেতা মোরকে সরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

সে সব পুরনো কথা। এখন প্রশ্ন হল নতুন গভর্নর শক্তিকান্ত দাস কতটা চাপের মুখে পড়বেন। তিনি নিজে অবশ্য বলছেন তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই চলবেন। তিনি নমনীয় অবস্থান নেবেন নাকি কঠোর হবেন পরের কথা, পাঁচ রাজ্যের ভোটে তিন রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়ে এবং অন্য দুই রাজ্যে শক্তি দেখাতে না পেরে বিজেপি সরকার তাঁকে কতটা চাপ দিতে পারবে, সেটাও প্রশ্ন।

আরও বড় প্রশ্ন হল, বিজেপি সরকার কি প্রাক্তন আমলার বাইরে এই পদের জন্য সত্যিই কাউকে খুঁজে পায়নি নাকি সরকারের প্রস্তাবে কেউ রাজি হননি। যদি সরকারের প্রস্তাব সকলেই ফিরিয়ে দিয়ে থাকেন তা হলে ভাবতে হবে সরকারর সব নীতি কি অর্থনীতির বিরোধী কিনা।

প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বিমল জালানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে আমলা হওয়া সুব্বারাওকেও নিয়েও প্রশ্ন ওঠেনি। রঘুরাম রাজনের নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু কোণঠাসা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির মতো প্রশ্ন উঠেছে প্রাক্তন আমলা তথা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের যোগ্যতা নিয়েও! সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার একটাই অর্থ, সরকার ব্যর্থ।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment