মনে পড়ে যায় ১৯৯৮ সালে স্টেডিয়ামে বসে ফ্রান্সের জয় দেখার কথা

এখনও মনে পড়ে ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়ার সেই সেমিফাইনা

 |  5-minute read |   15-07-2018
  • Total Shares

আমি খেলাধুলো পছন্দ করি। এটা আমার প্যাশন, ঠিক যেমন গান আমার প্যাশন। ছোটবেলায় পাড়ার মেয়ে-বন্ধুদের সঙ্গে নানা খেলাধুলো করতাম। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে অসমের তিনসুকিয়ায়। এটা একসময় উত্তরপূর্ব ভারতের বাঙালি প্রধান শহর ছিল।

তারপর চলে এলাম কলকাতায়, 'বঙ্গাল খেদাও' আন্দোলন থেকে প্রাণ বাঁচাতে। আরও পরে সত্তরের দশকে ফ্রান্সে আসি, যদিও তখন ভাবিনি যে এখানেই পাকাপাকি ভাবে থেকে যাব। তবে এখানেই জীবনের প্রায় তিন ভাগ পেরিয়ে গেছে। দেশটা আমার কোনও দিনও বিদেশ বলে মনে হয়নি। তারপর এখানেই পড়াশোনা, চাকরি ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। প্যারিসে এসে আমি টেনিস খেলার অনুরাগী হয়ে উঠি। আশির দশকে ফ্রেঞ্চ ওপেন থেকে শুরু করে ইউএস ওপেন পর্যন্ত সব খেলাই আমি দেখি।

body1_071518054839.jpg১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে ফ্রান্সের তারকারা

এবার আসি ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের কথায়। সে বছর ফ্রান্সের মাঠে আয়োজিত হয়েছিল এই ফিফা বিশ্বকাপ। কলকাতা থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানালেন যে উনি ফ্রান্সে আসছেন ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করবেন বলে। তাই তিনি আমার অতিথি হতে পারেন কী না সেটা জানতে চেয়েছিলেন। সেটা জুলাই মাস। আমার ছেলেমেয়েদের স্কুল ও কলেজের ছুটি ছিল, আমারও তখন ছুটি চলছিল। সে বছর কলকাতা থেকে বহু সাংবাদিক এখানে বিশ্বকাপ কভার করতে এসেছিলেন। আমিও ওঁদের সঙ্গে বিশ্বকাপের আনন্দে মেতে উঠলাম। তখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও তাঁর স্ত্রী দীপাও এসেছিলেন এখানে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে এসেছিলেন মানস চক্রবর্তী, সুমন চট্টোপাধ্যায় ও দীপক সাহা প্রমুখ। খেলোয়াড়দের মধ্যে এসেছিলেন চুনি গোস্বামী, সুকুমার সমাজপতি, শিশির ঘোষ দস্তিদার, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

ফিফা রেফারি মৃণালকান্তি রায় এসেছিলেন শিলচর থেকে। এ ছাড়া ছিলেন অজিত ঘোষ। আমার এক বন্ধুও এসেছিলেন লন্ডন থেকে। ওঁরা লিয়ন-এ (Lyon) যাবে কোয়ার্টার ফাইনাল দেখতে। চার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা যখন লিয়নে পৌঁছলাম তখনও খেলা শুরু হতে ঠিক এক ঘণ্টা আগে। খেলাটা ছিল ক্রোয়েশিয়া ও জার্মানির মধ্যে। তারিখটা ছিল ৪ জুলাই। খেলা হচ্ছিল ছিল স্টাদে দ গেলাঁ (Stade de Gerland) নামে স্টেডিয়ামে।

body3_071518055539.jpg১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে ফ্রান্সের সমর্থকরা উল্লাস করছেন

স্টেডিয়ামটিতে দর্শকাসনের সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার মতো। ওখানে খেলা দেখতে গিয়ে যা ভিড়! আমার তো সে কি ভয়! সর্বনাশ এই জনস্রোত ঠেলে আমি কী করে মাঠে ঢুকব! যাই হোক, অবশেষে টিকিট নিয়ে কোনও রকমে ঠেলেঠুলে মাঠে ঢুকে নিজের আসনে গিয়ে বসলাম।

সে কী বিশাল মাঠ। ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা পতাকা নিয়ে নিজেদের ভাষায় চিৎকার করছিলেন। ওখানে সবাই একজন শাড়ি পরা, টিপ পরা ও শাঁখা-সিঁদুর পরা মহিলাকে দেখে অবাক চোখেই তাকিয়ে দেখছিলেন।

আমি তখন কোনও দলকেই সমর্থন করছিলাম না। কিন্তু আসপাশে সবাইকে দেখে মুখে-চোখে আমিও এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম যেন আমি ওঁদের দেশকেই সমর্থন করছি। ওঁদের সঙ্গে গান ধরলাম আর ওঁদের হাতে হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার উঠে দাঁড়ালাম, আবার বসে পড়লাম। সেদিনের খেলায় ছিল টানটান উত্তেজনা। ক্রোয়েশিয়া পর পর তিনটে গোল দিয়ে বসল। ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করল এবং ভেঁপু বাজিয় আবার গান ধরল। সবাই সবাইকে আলিঙ্গন করতে শুরু করল, যেন ওঁরা সবাই এঁকে ওপরের ভীষণ পরিচিত। 

ওখানে যা যা ঘটেছিল সবকিছু অভিভূত হয়ে দেখেছিলাম সেদিন। মাঠে তখন সমর্থকরা নেমে গেছে ভেঁপু-বাঁশি নিয়ে এবং খেলোয়াড়দের মাথায় তুলে নাচতে শুরু করেছে। আনন্দের আতিশয্যে ওঁরা যে ঠিক কী করবে ভাবতে পারছিল না। আমার জীবনের এটা একটা অভাবনীয় অভিজ্ঞতা।

এর পরের অভিজ্ঞতা হল ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে সেমি ফাইনালের খেলা দেখতে গিয়ে। খেলাটা হয়েছিল স্টাডে দ ফ্রাঁস (Stade de France) স্টেডিয়ামে। এই স্টেডিয়ামটি প্যারিসের উত্তর প্রান্তে, ফ্রান্সের সব চেয়ে বড় স্টেডিয়াম, যেখানে দর্শকাসন প্রায় আশি হাজার। এ বারেও আমার সঙ্গে একজন বাঙালি সাংবাদিক ছিলেন। আমি আর আমার ছেলে কুশল ঢুকে পড়লাম একটা গেট দিয়ে। ওমা! কাকে দেখছি আমার ঠিক পেছনের আসনে বসে? আমাদের সকলের প্রিয় তারকা মিঠুন চক্রবর্তী! হাসি মুখে সম্ভাষণ জানালাম আমরা।

body2_071518055433.jpg১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে বিখ্যাত রাস্তা আভান্যু দো সজাঁলিজেতে জনস্রোত

সে বার আমি ফ্রান্সকে সমর্থন করেছিলাম। আমার নানা মন্তব্যে আমার ছেলে বিরক্ত হচ্ছিল আর আমাকে 'তুমি কিছু বোঝ না' বলে থামিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি কী আর থামি! প্রচণ্ড উত্তেজনা ফেটে পড়ছিলাম আমি। কে প্রথম গোল দেবে সেটা ভেবেই উত্তেজনা আরও বেড়ে যাচ্ছিল। ফরাসিরা খুব শান্তশিষ্ট, তাঁরা বেশি চেঁচামেচি পছন্দ করেন না। ওঁরা মুখ ভারী করে শক্ত হয়ে বসেছিল গোলের ঘরের দিকে তাকিয়ে। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সই জিতে গেল ২-১ গোলে। এ বার গ্যালারিতে বসে থাকা সব ফরাসি মাঠের খেলোয়াড়দের প্রতি সম্মান জানিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফরাসি জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলেন। মাঠে নেমে গেলেন কিছু লোক নাচ-গান শুরু করে দিল কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে।

জনসমুদ্রে ভেসে গেল অত বড় স্টেডিয়ামের একটা বিশাল মাঠ। তখন মাঠে আর ঘাস দেখা যাচ্ছিল না। কী যে খুশি হয়েছিলাম সেদিন ফ্রান্সের সাফল্যে বলার নয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে স্টেডিয়াম থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম তারপর সবাই মিলে একটা কাফেতে বসে সেই আনন্দ উদযাপন করেছিলাম। রাস্তায় গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে, হাত নাড়তে নাড়তে ও খুব জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

১৯৯৮-এর শেষ বিশ্বকাপের শেষ দিনটা ছিল ১২ই জুলাই, রবিবার। খেলা হয়েছিল ব্রাজিলের সঙ্গে ফ্রান্সের। বড় টিভিতে খেলা দেখব বলে সেবার আর মাঠে যায়নি। কারণ স্টেডিয়ামে বসে দূরে ভালো ভাবে খেলা দেখা যায় না। বাঙালিরা তো সবাই ছিল ব্রাজিলের দলে। মজা করে আমি ওঁদের বলেছিলাম যে ফ্রান্সে বসে ব্রাজিলের জয়ধ্বনি দিলে চলবে না!

body4_071518055415.jpg১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে বিখ্যাত রাস্তা আভান্যু দো সজাঁলিজেতে জনস্রোত

দেশের মান রাখতে ফ্রান্সকে জিততেই হবে। আমি মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম। আমাদের সকলকে চমকে দিয়ে ফ্রান্স পর পর তিনটে গোল দিল। আমি চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠলাম। আমার সঙ্গে বসে যাঁরা খেলা দেখছিলেন তাঁরা বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই কোনও তুক করেছ দীপাদি।”

প্যারিসের Champ Elysee-তে তখন মানুষের বাঁধ ভাঙা ঢল নেমে পড়েছে। সবাই গাড়ির উপরে উঠে পড়ে উল্লাস করতে লাগল এবং নাচানাচি শুরু করে দিল। আমি তখন সবাইকে নিয়ে সেই উৎসবে যোগ দিতে ছুটলাম। ওখানে গিয়ে হাতে হাত ধরে আমরাও জনস্রোতের সঙ্গে মিশে গেলাম। চিৎকারে পাশের মানুষটারও কথা শোনা যাচ্ছিল না। সেদিন দু’চোখভরে সেই উল্লাসের সাক্ষী হয়ে রইলাম। এতগুলো বছর এই দেশে আছি, কিন্তু এত আবেগ ও উচ্ছ্বাস আগে কখনও দেখিনি। প্যারিসের সব মানুষ সেদিন পথে নেমে পড়েছিল। সেদিন আমরাও বুকভরা সুখ নিয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরলাম। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই ১২ জুলাই ১৯৯৮, ফ্রান্সের জয়, ফ্রান্সের গর্বের দিনটার কথা।

body5_071518055011.jpgফ্রান্সের এই গ্রামের একটি বাড়ির সামনে ঝুলছে দেশের পতাকা

এবারেও ফ্রান্সের খেলা দেখতে দেখতে ৯৮-এর কথা মনে পরে যাচ্ছিল যখন মাঠে বসে খেলা দেখেছিলাম।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUDIPTA CHAKRAVARTY REMY SUDIPTA CHAKRAVARTY REMY

A Bengali, now French citizen

Comment