সিকিমের প্রথম বিমান: বড় পাওনা, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্বর্গরাজ্য পৌঁছাতে পারা
আতঙ্ক থেকে উদ্ধার করলেন শিখ পাইলট, তিনি আগে বায়ুসেনার বিমান চালাতেন
- Total Shares
যেন কোনও এক স্বর্গরাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি।
আমার বাপাশে একের পর এক অপূর্ব সুন্দর হিমালয় পর্বতমালার শৃঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে থেকে আমাদের অতি প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োও উঁকি মারছে। আর ডানদিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি খাদ। একটু ঝুঁকতে পারলে হয়ত চোখের সামনে বেশ কিছু পাহাড়ি গ্রামও ভেসে উঠতো। আর এই ছবির মতো সুন্দর দৃশ্যগুলোর মাঝেই আমাদের বিমাটি পেকিয়ং বিমানবন্দরের রানওয়ে ছুঁলো।
ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে পেরে আমি তখন যারপরনাই উত্তেজিত। চৌঠা অক্টোবরের কথা। সেদিন দুপুরে স্পাইস জেটের বোম্বাদিয়ার বিমানটি প্রথম যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে সিকিমে অবতরণ করল। ঘড়ির কাঁটা তখন সবেমাত্র আড়াইটে ছাড়িয়েছে।
তার আগে অবশ্য এক প্রস্থ নাটক হয়ে গিয়েছে কলকাতা বিমাবন্দরে। নাটক না বলে আতঙ্কই বলা ভালো। সকাল ৯.৩০ মিনিটে বিমানটি কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ওড়ার কথা ছিল বিমানটির। কিন্তু পেকিয়ং বিমানবন্দরে দৃশ্যমান্যতা কম থাকার জন্য বিমান ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। আমি, সিকিম বেড়াতে যাচ্ছিলাম না। শুধুমাত্র প্রথম বিমানের চড়ার সাক্ষী হিসেবে আমার এই যাত্রা।
জলকামান দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হল বিমাটিকে [ছবি: লেখক]
তাহলে কি যাত্রা পন্ড হবে - আতঙ্কে তখন তো আমার লোম খাড়া হওয়ার জোগাড়।
শেষ পর্যন্ত বিমানের ৭৪ জন যাত্রীর উদ্ধারে এগিয়ে এলেন এক শিখ পাইলট। ভদ্রলোক নাকি আগে এয়ারফোর্সের বিমান চালাতেন। দুর্গম বিমানঘাঁটিতে ওঠা-নামার অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে তার হাতেই প্রথম বিমানের দায়িত্ব ছেড়ে ছিলেন স্পাইস জেট কতৃপক্ষ। সত্যিই, অসামান্য দক্ষতায় তিনি সিকিমের ওই পুচকে পাহাড়ি বিমানবন্দরে বিমানটিকে নামালেন।
বিমান অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই দু'দিক থেকে জলকামান চালিয়ে বিমানটিকে ধুইয়ে দেওয়া হল। এর পর আমরা একে একে বিমান থেকে নামলাম। নিচে তখন আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হাজারো লোক দাঁড়িয়ে। বিমাবন্দরের বা বিমান সংস্থার কতৃপক্ষরা তো আছেনই। সেই ভিড়ে চোখে পড়ল সিকিমের পর্যটন মন্ত্রীকে। আমরা নিচে নামতেই মাথায় চালের টিকা ও গলায় খাদা পড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হল। ভাবছেন খাদা জিনিষটি কী? আমাদের যেটা উত্তরীয় সিকিমে সেটাই খাদা।
ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে পেরে আমি যারপরনাই উৎসাহিত। তার চাইতেও বেশি আমার প্রিয় শহর কলকাতার সঙ্গে আমার প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সিকিমের দূরত্বটা (পড়ুন সময়) এক ঝটকায় এতটা কমে যাওয়ার জন্যে।
ছবির মতো সুন্দর বিমানবন্দরটি [ছবি: লেখক ]
প্রথমবার পরিবার নিয়ে সিকিম গিয়েছিলাম ২০০৩ সালে। আর, প্রথম দর্শনেই প্রেম। এর পর যে ওই স্বর্গরাজ্য কতবার গিয়েছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই। কিন্তু প্রতিবারই তো এক হয় রাতের ট্রেনে জলপাইগুড়ি বা সকালের বিমানে বাগডোগরা নেমে সেখানে থেকে গাড়িতে করে আরও ঘণ্টা পাঁচেকের যাত্রা।
এবারের গল্পটা একদম অন্যরকম। মাত্রা এক ঘণ্টা দশ মিনিট বিমানে যাত্রার শেষে আমি এখন সিকিমের রাজধানী থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি কলকাতা পুলিশে কর্মরত। যাঁরা আমাদের মতো পেশায় রয়েছেন তাঁদের ছুটিছাটা খুবই কম। আর, তাদের জন্য এই বিমানযাত্রা একেবারে আদর্শ। ট্রেন যাত্রার থেকে অন্তত দিন তিনেক সময় বাঁচিয়ে ফেলা সম্ভব সরাসরি বিমানে চেপে পেকিয়ং গেলে।
পরের দিনের বিমানে পেকিয়ং থেকে কলকাতায় ফিরেছি। ফিরে আসার পর অনেকেই প্রশ্ন করছেন শুধুমাত্র বিমানে চেপে পেকিয়ং গিয়ে আবার ফিরতি বিমানে কলকাতায় ফিরে আমি ঠিক কী আনন্দ পেয়েছি।
আমার আনন্দটা কোথায় জানেন?
স্বর্গ যে এখন আমার নাগালের মধ্যে। মাত্র ঘণ্টাখানেকের বিমান যাত্রা।