পশ্চিমবঙ্গে টেরাকোটার মন্দিরই কেন হতে পারে পর্যটনের জিয়নকাঠি
মন্দিরের গায়ে কী কাহিনি উৎকীর্ণ রয়েছে লোকে সেটাই শুনতে চায়, বলার কেউ নেই
- Total Shares
হিন্দুস্তান কা দিল দেখো...
মধ্যপ্রদেশ পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপনে খুব ভেবেচিন্তে এই কথাটি ব্যবহার করা হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশে অন্তত পাঁচটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থাকলেও তারা সুচিন্তিত ভাবেই জোর দিত ভোপালের সরোবর দেখার উপরে।
ভারতে অনবদ্য স্থাপত্যের অভাব নেই। তাজমহলই কি সবচেয়ে সুন্দর? বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু সরকার এই একটি সৌধকে এমন ভাবে বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরেছে তাতে ওই ভালোবাসার গল্প, পুরস্কার হিসাবে স্থপতি ঈশা খাঁর হাত কেটে নেওয়া, একটা গর্ত দিয়ে সূর্যের আলো শাহজাহানের মুখের উপরে পড়া... যেন ভারত প্রেমকথার সেরা গল্প। সেই গল্পের স্মারক চাক্ষুস করতেই দেশ-বিদেশের মানুষ আসেন তাজমহলে।
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল (ছবি: রয়টার্স )
আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও গল্প কম নেই। রাজা যখন মদনমোহন মন্দিরে বসে কীর্তন করছেন তখন শত্রুর আক্রমণ। স্বয়ং ভগবান কামান দেগে বসলেন। পালাল শত্রুরা, একবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে। গল্প শুনতে শুনতে মনে হল, মন্ত্রীমশায় নিশ্চয়ই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন, কামানটি তিনিই দেগেছিলেন বা কামান দাগার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মদনমোহনের কামান দাগার কথা বলায় তিনি বাঁচলেন রাজরোষ থেকে আর প্রজারা বাঁচলেন শত্রুর হাত থেকে।
বিষ্ণুপুর ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি অনেক মন্দির অসম্পূর্ণ। কেন? একরাতের মধ্যে মন্দিন নির্মাণ সম্পূর্ণ না করতে পারলে সেই মন্দির আর নির্মাণ করা যাবে না। সেই সব মন্দিরের গল্প, সাততালাও-এর গল্প... কত গল্প। মনে হয়, সেই সব গল্প দিয়ে কেন পর্যটকদের আকর্ষিত করতে পারে না এই রাজ্য।
সূর্য ডোবার পরে বাউলগানের আসর বসতে পারে রাসমঞ্চের মতো স্থাপত্যে
যাঁরা ‘হংসেশ্বরী’ পড়েছেন তাঁরা জানেন যে একটা মন্দির তৈরির গল্পকে কী ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নারায়ণ সান্যাল, কিছু সত্য বাকিটা কল্পনা। তেমন ভাবে গল্পটা শোনাতে হবে।
আসা যাক মন্দিরের কথায়। বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ধরনের মন্দির। কোনটি রেখমন্দির, কোনটি চালা মন্দির, কোনটি রত্ন মন্দির। আরও নানা ধরনের মন্দির রয়েছে। এই সব মন্দিরেরও আবার ভাগ রয়েছে। কালনা, কাটোয়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি এবং অবশ্যই বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরে রয়েছে পোড়াইটের বা পোড়ামাটির মন্দির, যাকে ইংরেজিতে বলে টেরাকোটা। একা এই টেরাকোটা মন্দিরের জোরে দীর্ঘদিন ধরে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে বিষ্ণুপুর।
বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দির (নিজস্ব চিত্র)
সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ভারতে জাপান দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল। তাঁরা সেখানে টেরাকোটা মন্দির দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। মুগ্ধ হওয়ারই কথা। টেরাকোটা মন্দির হল বাংলার নিজস্ব। যাঁরা বাংলায় আসেন তাঁরা চার্চ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ও জাদুঘরের চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ হতে পারেন টেরাকোটা মন্দির দেখে – ইউরোপে তাবড় জাদুঘর রয়েছে, যা ধারে-ভারে আমাদের দেশের চেয়ে এগিয়ে – পোড়াইটের মন্দির তো আর তাঁদের দেশে নেই!
প্রশ্নাতীত ভাবে দার্জিলিং সুন্দর। টয়ট্রেনও অনবদ্য। তবে শৈলশহর এদেশে অনেক রয়েছে, পাহাড়ের গা ঘেঁসে চলা ট্রেনও রয়েছে। চা-বাগানও রয়েছে। একইসঙ্গে এই সব সৌন্দর্য দেখার উপায়ও রয়েছে দেশের অন্যত্র।
বিশ্বের সবেচেয়ে বড় লবনাম্বু উদ্ভিদের অরণ্য (ম্যানগ্রোভ) সুন্দরবন, যার দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে। ভারতের দিকে যে অংশ রয়েছে সেখানে গেলে বাঘ দেখা যাবে? গ্যারান্টি আছে? যাঁরা রনথম্ভোর-কানহা-পান্না গিয়েছেন তাঁরা বাঘ দেখতে সুন্দরবনে যাবেন না। তা হলে কী দেখতে যাবেন?
সুন্দরবন উত্তরবঙ্গের কোনও বন নয় যে বাংলোয় বসে গরম পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অরণ্যকে উপভোগ করবেন। তা হলে?
সে সবের ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলা যায়, পোড়াইটের মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে অন্য ধরনের পর্যটন। ইটের গায়ে যে পৌরাণিক কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেই কাহিনি গল্প করে বললে লোকে আগ্রহ ভরে শুনতে পারে। সেই গল্প যত ছড়িয়ে পড়বে ততই লোকের আগ্রহ বাড়বে।
মন্দিরের গায়ে কে কাহিনি উৎকীর্ণ রয়েছে সেই গল্প শোনাতে চান, পর্যটকই তো নেই! (ফাইল চিত্র)
গুজরাটের মোঢেরায় সূর্যমন্দির যখন দেখতে ঢুকি ততক্ষণে সেখানে বাঁশি বাজিয়ে মন্দিরচত্বর খালি করে দেওয়া হয়েছে। পর্যটক আমি একা, সঙ্গে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের এক শীর্ষ আধিকারিক। গল্প করতে করতে গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তাঁরা যে এত সব গল্প বলেন, বিশেষ করে মন্দিরের কোথায় কোন বিশেষ দৃশ্য আছে তা তাঁদের নখদর্পনে, এটা কেমন করে সম্ভব।
উনি বলেছিলেন, যখন পর্যটক কম থাকে তখন ওঁরা মন্দির খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন কোথায় কী আছে। তারপরে অনেক সময় ব্যাখ্যা নিজেরাই তৈরি করে নেন, ভাস্কর্যের সঙ্গে সাজুয্য রেখে। পর্যটকরা সে সব শুনতে ভালোবাসেন। রাজ্যের পর্যটনের পালে হাওয়া লাগাতে পোড়ামাটির মন্দিরগুলোর গল্প শোনাতে হবে (গালগল্প নয়), স্থানীয় ইতিহাসবিদদের এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ বার আসা যাক বাউলগানের কথায়। জাপানি ওই প্রতিনিধিদলটির বাউলগানও বেশ পছন্দ হয়েছে। একতারা ও দোতারা হাতে বাউল গান বাংলার নিজস্ব। কথা ও সুরে মাদতকা রয়েছে। বাউলগান শোনাতে হবে পর্যটকদের।
মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে নানা কাহিনি (নিজস্ব চিত্র)
বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটন দপ্তর তাদের রাজ্যের নিজস্ব সংস্কৃতি (আদপে আদিবাসী সংস্কৃতি) তুলে ধরেন পর্যটকদের কাছে। বেড়ানো শেষ হওয়ার আগে সেই আদিবাসী শিল্পীদের নাচগান দেখেন পর্যটকরা। সরকারি অতিথিশালাতেও এই বন্দোবস্ত থাকে। এ রাজ্যেও ইটের মন্দির দেখানোর পরে দিনের শেষে বাউলগান শোনানোর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
শুধু বাউল গান কেন, বীরভূমে পটশিল্পীরাও বিখ্যাত। তাঁরা পট দেখিয়ে গানও শোনান। একদিন বাউল গান হলে পরের দিন পটের গানও শোনানো যেতে পারে। সূর্য যখন অস্তাচলে যাচ্ছে তখন রাসমঞ্চের নীচে গান ধরেছেন বাউল কিংবা অন্য কোনও টেরাকোটা মন্দিরের দালানে গান শোনাচ্ছেন কোনও পটশিল্পী...
সেই ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করলে পর্যটক আসবেন না, তা হতে পারে!