অবনীর জন্য শোক পালন বৃথা: আরও হাজার অবনীর কপাললিখন একই
বিস্ফোরক উৎপাদক সংস্থার জন্য জঙ্গল কাটা হচ্ছে নাগপুরে, বাঘ তা হলে জাহান্নমেই যাক
- Total Shares
সবে মাত্র অবনীর মৃত্যুর শোক ভুলতে বসছিলাম আমরা। সেই সময়তেই উত্তরপ্রদেশের দুধওয়ার খবরটা এল। জঙ্গলে স্থানীয় এক মানুষকে আক্রমণ করার জন্য গ্রামবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে একটি বাঘকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
তবে এই খবরটা পেয়েই আপনার মনটা যেন ভরাক্রান্ত না হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু বাঘ, বাঘিনী ও ব্যাঘ্র শাবকদের জন্য আমাদের শোক পালন করতে হবে।
বন পরামর্শদাতা কমিটির বিরুদ্ধে নয়া অভিযোগ উঠেছে। এই কমিটি নাকি নাগপুর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালমেশ্বর রেঞ্জের কন্ধালি এলাকার ৮৭.৯৮ হেক্টর জমিতে জঙ্গল সাফ করে দিয়েছে। অবনীকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেই যবতমাল থেকে এই অঞ্চলটি মাত্র ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, এই অঞ্চলের চাকদহ এলাকায় বিস্ফোরক পণ্য উৎপাদন সংস্থা সোলার ইন্ডাস্ট্রিস ইন্ডিয়া লিমিটেড (সিল) প্রতিরক্ষা বাহিনির ব্যবহৃত পণ্য উৎপাদনের কারখানা তৈরি করবে।
খবরের প্রকাশ, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২২২ একর জমি সিলের জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে এটি প্রথম ভারতীয় সংস্থা যা মিসাইল উৎপাদনের বরাত পেয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের দুধওয়ায় ট্র্যাক্টর দিয়ে পিষে মারা হয়েছে এই বাঘিনীকে {সৌজন্য: রণদীপ হুন্ডা/টুইটার]
আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে, যে পরিমান জমি এই সংস্থাটির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেই পরিমান জমিতে ২৯৩টি আন্তর্জাতিক মাপের ফুটবল স্টেডিয়াম তৈরি করা যেত। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির বাজার দর নয় নয় করে ১০০ কোটি টাকা।
তবে বাধ্যতামূলক অরণ্যায়ন বা বৃক্ষরোপণের খাতে ও কৃত্রিম পাখির বাসা তৈরির জন্য সিল আপাতত ৭.০৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। শুরুতে ৭৫০টি কৃত্রিম পাখির বাসার জন্য ৩.৩৭ কোটি টাকা ব্যয় করবে সিল। সংস্থার ব্যবসায়িক অধিকর্তা জে এফ সালভে জানাচ্ছেন, "সংরক্ষণের জন্য আমরা পাঁচ বছরে এক কোটি টাকা (বছরে ২০ লক্ষ করে) বনদপ্তরকে দেব।"
বিশেষজ্ঞ কমিটিগুলোর তিন তিনটে জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে অঞ্চলটিকে সিলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেই অঞ্চলে চারটি বাঘ ও শাবকদের নিয়ে আরও দুটি বাঘিনী বাস করে। বনাঞ্চলকে শিল্পের কাজে ব্যবহার আগে এই জরিপের গুরুত্ব অপরিসীম।
এই জরিপগুলোতে আরও জানানো হয়েছে যে এই অঞ্চলে কম করে ছ'টি চিতাবাঘ থাকে। আর বাঘ ও চিতা বাঘের শিকারের জন্য জায়গাটি একেবারে আদর্শ। কারণ, এই অঞ্চলের পাঁচ কিলোমিটারের ব্যাসার্ধের মধ্যে দু'ধরণের হরিণ (কৃষ্ণসার ও চিতল), বন্য কুকুর, সম্বর, নীলগাই ও গন্ধগোকুলের সংখ্যা যথেষ্ট।
সালভে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, "নির্দিষ্ট জমির মাত্র সামান্য কিছু অংশ সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত পণ্য উৎপাদনের জন্যে ব্যবহার করা হবে। জমির বাকি অংশটা প্রয়োজন পড়ছে কারণ ওই অংশটুকু কারখানার নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করবে।" তিনি জানিয়েছেন যে বাধ্যতামূলক অরণ্যায়নের জন্য চন্দ্রপুরের শাওলী রেঞ্জের হিরাপুর অঞ্চলটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই অঞ্চলটি আবার মহারাষ্ট্র সরকারের বনমন্ত্রীর আদিবাড়ি। সংস্থাটিকে সমপরিমাণ জমি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে কারণ সরকারি প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার এই জমিটি সংস্থাটির জন্যে নির্দিষ্ট করেছে।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সঙ্ঘ (আইইউসিএন) জানিয়েছিল যে ১৯৯৭ সাল থেকে ভারতে বাঘের বিচরণ ভূমি ৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
I am deeply saddened by the way tigress Avni has been brutally murdered in #Yavatmal, #Maharashtra. #Justice4TigressAvni https://t.co/hX6wuf62Ec
— Maneka Gandhi (@Manekagandhibjp) November 4, 2018
রিপোর্টে বলা হয়েছে, "ভারতেই সবচেয়ে বেশি বনাঞ্চল সংকোচন হচ্ছে। উদ্ভিদবিদরা মনে করছেন এর প্রধান কারণ বিচরণ ভূমি হ্রাস পাচ্ছে।"
যে জমিটি সিলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা আদতে বোর ও মেলঘাট ব্যাঘ্রপ্রকল্পের মধ্যে বাঘেদের মূল যোগাযোগকারী পথ। এই পথ বন্ধ করে দিলে বাঘে বা বাঘিনীরা প্রজননের জন্য সঙ্গী পাবে না। এর ফলে একই পরিবারের মধ্যে প্রজননের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে এবং জিনগত সমস্যার সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে, যার প্রভাব বাঘেদের সংখ্যার উপরও পড়বে।
আরও একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হল দুই ব্যাঘ্রপ্রকল্পের সংযোগকারী পথ আটকে দিলে একটা প্রকল্পে ব্যাঘ্রসংখ্যার ঘনত্ব পড়বে। এর ফলে শিকারের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এই সবক'টি পরিণামের যোগফল একটাই। বাঘেরা খাবারের খোঁজে আরও বেশি করে জনবসতিতে হানা দেবে এবং বাঘে মানুষে সংঘাত সৃষ্টি হবে। অবনী বা দুধওয়ার থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ২৯ শতাংশ বাঘ সংরক্ষিত এলাকার বাইরে থাকে। ২০১৫ সালে ভারত দাবি করেছিল যে এ দেশের বাঘের সংখ্যা ২,২২৬টি যা বিশ্বে মোটর বাঘের সংখ্যার ৭০ শতাংশ। ভারতের দাবি ছিল যে ২০০৬ সালে এ দেশে মাত্র ১,৪১১টি বাঘ ছিল এবং ন'বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই থেকেই সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ বাঘের সংখ্যার বৃদ্ধির অনুপাতে বাঘেদের উপযুক্ত বিচরণ ভূমির দ্রুত হ্রাস পাওয়া। বিচরণভূমি বৃদ্ধি না করলে বাঘে-মানুষে সঙ্ঘাত যে বাড়বে তা তাঁরা বারংবার সতর্ক করেছেন।
তাই সরকারের এই জঙ্গল কেটে শিল্প বৃদ্ধির নীতি দেখে প্রশ্ন উঠছে, "বাঘেরা তাহলে যাবে কোথায়?"
প্রশ্নের উত্তর একটাই: 'জাহান্নামে'।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে