অসমে মিয়াঁ মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কেন দেখা হয়?
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি আলিফা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছে
- Total Shares
ছোট্ট আলিফা নিচু একটা টিলার উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিল, কবে সে গুয়াহাটি শহরের পাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটবে আর শহরে য়ারা থাকে, তাদের সুন্দর বাড়িগুলোতে উঁকি মেরে দেখবে, তারা ঠিক কেমন, তারা কী-ই বা করে।
একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লড়াই করে বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে আলিফা, দীপ চৌধুরীর পরিচালনায় এটাই প্রথম ছবি।
ছোট আলিফা ও তার পরিবার একটি টিলার উপরে বাস করে, যেখান থেকে গুয়াহাটি শহরের বেশ কিছুটা দেখা যায়। ছবিতে আলিফার বাবা-মা আলি ও ফতিমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পোড়খাওয়া অভিনেতা বাহারুল ইসলাম ও জয়া শীল। সিনেমায় তাঁরা দিনমজুর। আলিফা ও তার ছোট ভাই ফয়জল বাড়িতেই থাকে, তবে সুযোগ পেলেই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
এ ভাবে ঘুরে বেড়ালে মা তো বকবেই। এখন তারা ভাবছে, কবে যে কাছাকাছি একটা স্কুল খুলবে, যেখানে তারা আবার পড়াশোনা শুরু করবে। ওই টিলায় থাকা অন্য পরিবারের মতো এরাও পূর্ব বাংলার মুসলমান যাদের 'মিয়াঁ' মুসলমানও বলা হয়। ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদী বেঁকির বানে এরা নিজেদের ঘরবাড়ি সমেত সবকিছুই হারিয়েছে।
তাই বাধ্য হয়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে এঁরা বন-জঙ্গলময় এলাকায় অবৈধ ভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু সেখানেও তাঁরা খুব একটা শান্তিপূর্ণ ভাবে বাস করতে পারেন না। যাতে তাঁদের ওই সব এলাকা ছেড়ে তা যেতে হয়, সে জন্য তাদের টাকাও খরচ করতে হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকরা তাঁদের আর্থিক ভাবে শোষণ করতেন। ঘুরিয়ে বদলে গেলে, এই আধিকারিকদের দয়ায় দিন গুজরান করতে হত এঁদের। টাকা দিতে দেরি হলে এদের ওই এলাকা থেকে উৎখাত করার হুমকিও দিতেন ওই সব আধিকারিকরা।
আলির দুস্থ পরিবার আরও অসুবিধায় পড়েন যখন তার বাবা যে নির্মাণ সংস্হায় মজুরের কাজ করতেন, সেখান থেকে কাজ হারান। সংসার চালাতে জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে যখন শহরে গিয়ে নানা ছোটখাট কাজ করতে হয়, আর কাজ করতে গিয়ে তাঁকে সামাজিক অবস্থা ও ধর্মের জন্য নানা অপমানজনক কথা শুনতে হত। বাংলাদেশি বলে অনেকসময় তাঁকে মিয়াঁ বলে হেয় করা হত। এ দেশে অবৈধ ভাবে বহু বাংলাদেশি মুসলমান ঢুকে পড়েছে বলেই তাঁকে এই ধরনের অপমান সহ্য করতে হত আবার বিড়ম্বনাতেও পড়তে হত। সমাজের একটা বড় রাজনৈতিক পটভূমি উঠে এসেছে এই সিনেমায়।
ছবির আরেকটি দিকও রয়েছে। স্ত্রীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে আলির সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এই ঘটনায় আলির অহম-বোধে ধাক্কা লাগে, কারণ তিনি মনে করতে শুরু করেন, নিজের সংসারকে স্বচ্ছন্দে রাখতে পারছেন না, একই সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সব মিলিয়ে ওই টিলায় বসবাসকারী অন্যদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। তাতে তাঁর ব্যক্তিজীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
প্রকৃতির খেয়াল আর সমাজের ফেরে যাঁদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে, তাঁদের নিয়েই এই ছবি। ছবিতে এক জায়গায় দেখানো হয়েছে, একটা চিতাবাঘ কী ভাবে টিলায় থাকা লোকজনকে আক্রমণ করছে। কিন্তু সেই বন্যপ্রাণীর হামলা থেকে বাঁচার রাস্তাও তাঁদেরই বার করতে হচ্ছে। ওই চিতাবাঘের হামলায় একদিন প্রাণ যায় আলিফারও। আলিফার মৃত্যুতে আলির জীবনে সমস্যা আরও বহুগুণ বেড়ে যায়।
সিনেমার শেষে দেখানো হয়, আলিফার মৃত্যুকে ঘিরে তার পরিবারের লোকজন নানা কথা বলছেন। ছবিটিই যেমন দেখান হয়েছে যে আলিফার মা-বাবা কন্যাকে হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন, তেমনই দেখানো হয়েছে, দিদির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ছোট্ট ফয়জল জঙ্গলের গভীরে ঢুকছে। ফয়জল যখন ফিরে আসছে তখন তার মুখটা দেখলেই মনে হবে যে সে তার দিদির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গেলে কী পরিণতি হতে পারে, সেটা সে বুঝে গিয়েছে। ফয়জলের বাবা যেমন প্রকৃতি আর সমাজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন, ছোট্ট ছেলেটিও যেন ঠিক তাই করছে।
টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আলিফা ভেবেছিল, সে একদিন শহরের পাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটবে, শহুরে লোকের বাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখবে – কিন্তু তার জীবনের সঙ্গে তার সেই স্বপ্নটাও শেষ হয়ে গেল অকালেই।
কী ভাবে নানা রাজনৈতিক সমস্যা অসমের মানুষের জীবনকে জর্জরিত করেছে, সেটাই এই ছবির মধ্য দিয়ে উঠে আসে। পূর্ববঙ্গের অনেক মুসলমানই এ দেশে অনুপ্রবেশ করেছে, য়াদের মিয়াঁ মুসলমান বলে হেয় করা হয়। আর তাদের সঙ্গে এ দেশের নাগরিক মুসলমানদের সঙ্গে অনেকেই তফাৎ করতে পারেন না বলে তাঁদেরও অনুপ্রবেশকারী বলেই দরে নেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয়কে আরও ভালো ভাবে উপস্থাপনার জন্য জায়গায় জায়গায় অসমীয়া ভাষা, ময়মনসিংহের উচ্চারণ ও ভাটিয়ালি উচ্চারণ বজায় রেখেই বানানো হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য ও প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাতের দিকটাও দেখান হয়েছে এই সিনেমায়। জঙ্গলের কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিক কী ভাবে তাঁদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁদের শোষণ করছেন, তাও ঘুরে ফিরে এসেছে এই ছবিতে। আবার অনেকে সেই সব আধিকারিকদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে নিজেদের সীমানা বাড়িয়ে চলেছে। এই ছবিও তুলে ধরেছেন পরিচালক।
এ ভাবে এলাকা দখল করে সীমানা বাড়িয়ে নেওয়া, উচ্ছেদ ও উচ্ছেদ হওয়া লোকজনকে সরকারি জমি বোইনি ভাবে বিক্রি করে দেওয়া, সরকারি জমিতে বেআইনি ভাবে থাকতে দিয়ে তাদের থেকে ভাড়া-বাবদ টাকা নেওয়া, এমন বহু ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এই সব অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত কারোরই কোনও শাস্তি হচ্ছে না।
ছবি: স্ক্রিন গ্র্যাব
প্রকৃতি ও মানুষের সংঘাত এখন মারাত্মক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, বিশেষ করে অসমে। মাঝে মধ্যেই হাতির তাণ্ডবের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আসলে বন কেটে মানুষ বসতি তৈরি করার জন্যই বেনর প্রাণীরাও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। সব মিলিয়ে এমন বিপর্যয়-পরিস্থিতি। আবার সামাজিক পরিচয়ের দুর্বিপাকে মিয়াঁ মুসলমানরা যে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন একই সঙ্গে সেই দিকটাও দেখান হয়েছে। গুয়াহাটি শহর মজুর-শ্রেণী বলতে এঁদের উপরেই নির্ভরশীল, অন্য কোনও কাজের সুযোগও তাঁদের নেই, তাই সামাজিক সম্মানটুকুও তাঁরা খুইয়ে বসেছেন।
সিনেমায় আলিফার এক ইচ্ছার মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে, উচ্ছেদের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে স্কুল-পড়ুয়াদের, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দারিদ্র্য ও দৈনন্দিন জীবনের বাঁচার লড়াই আলিফা ও তার ছোট ভাইয়ের প্রতাগত শিক্ষার পক্ষে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তাদের মা যেমন নিজের জীবনে একটু স্বচ্ছন্য্র ও সুখ আশা করেছিলেন ঠিক তেমনই ছোট্ট আলিফা ও তার ভাইও পড়াশোনা করতে চেয়েছিল আর আলি চেয়েছিলেন একটু সম্মান।
ছবিটিতে পরিচালক খুব সুন্দর ভাবে এই উদ্বাস্তু কর্মীদের কষ্টের কথা এবং কী ভাবে তাঁরা জীবনযুদ্ধ করে চলেছেন তা তুলে ধরেছেন। অভিবাসন, অবৈধ ভাবে জায়গা দখলের মতো সমস্যাগুলোকে সিনেমায় খুব নিপুণ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালকের মানবিক দিকেরও পরিচয় পাওয়া যায় এই ছবি থেকে।
তবে একটা ব্যাপার ছবিতে বাদ পড়ে গিয়েছে, ভূমিধসের জন্য মানুষজন কী ভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছেন, এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ায় তাঁদের সামাজিক কী সমস্যা হচ্ছে এটাও তুলে ধরা উচিত ছিল। তাঁরা একই জায়গায় অনেকদিন বসবাস করছেন, এমন উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না। ছবিতে দেখান হয়েছে কী ভাবে আদিবাসীরা ভূমিধস ও জীবিকার অভাবে বাধ্য হয়েছিলেন নিজেদের জায়গা ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করতে। প্রকৃতিই তাদের শিখিয়ে দিয়েছে কী ভাবে দলবেঁধে বসবাস করতে হয়।
এ মাসের ৬ তারিখে অসম ও পশ্চিমবঙ্গে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। পুরস্কার পাওয়া এই ছবিটি নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজে নৈতিকতা ও সহমর্মিতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

