দেশের প্রথম মুসলমান নারীবাদী কী ভাবে মহিলাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন?

বাংলাদেশে শেখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি, পরে যা কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়

 |  4-minute read |   23-03-2018
  • Total Shares

যখন কোনও সংগ্রাম দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে তখন ছোট ছোট জয় দিয়েই এগনো উচিৎ। যেমন ধরুন ওমপ্রকাশ মিশ্রের পপ-ভিডিও। আবার যেমন "ওয়াইফ অ্যাপ্রিসিয়েশন ডে"-তে নিজেদের বিজ্ঞাপন নিয়ে উবেরের ক্ষমা চাওয়া। কিংবা, 'ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড' এবং 'স্ট্রেঞ্জার থিংগস'-এর মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠাগুলোকে পিছনে ফেলে হুলুর 'দ্য হ্যান্ডমেড'স টেলের' এমিতে সেরা ড্রামা সিরিজের শিরোপা পাওয়া।

বিজেপির ইস্তাহারের সঙ্গে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর যা সম্পর্ক দ্য হ্যান্ডমেইডস টেলের সঙ্গে নারীবাদীর সম্পর্ক কতকটা তাই। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত মার্গারেট  থ্রিলারটি নিঃসন্দেহে অনবদ্য। কিন্তু এ ধরনের সাহিত্য  আগেও রচিত হয়েছে। 

৮০ বছর আগে বেগম রোকেয়া হোসেন নারীবাদী নিয়ে একটি কল্পলোকের গল্প রচনা করেছিলেন, 'সুলতানার স্বপ্ন'। লেখাটিতে পরিহাস করে জেনানার (বাড়ির একাংশ যেখানে মহিলাদের অন্তঃপুরবাসী করে রাখা হয়) বদলে 'মর্দানা'র কথা ভেবেছেন কেন্দ্রীয় চরিত্র সুলতানা, অর্থাত্ সেখানে পুরুষরা অন্তঃপুরে থাকবে।

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের পায়রাবান্ধায় এক উচ্চবিত্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া। তিনি একধারে লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী ছিলেন। অন্যদিকে, তিনিই ভারতের প্রথম মুসলিম নারীবাদী হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিলেন। যদিও সাবিত্রী ফুলে বা পণ্ডিতা রমা বাঈয়ের মতো মহিলারা পরবর্তী কালে বিপুল জনপ্রিয়ত লাভ হয়েছিলেন। রোকেয়ার কাজ কিন্তু সেই অর্থে জনমানসে জায়গায় করে নিতে পারেনি। 

body1_032318115554.jpgলেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী ছাড়াও তিনি ভারতের প্রথম মুসলিম নারীবাদী হিসেবে পরিচয় লাভ করেন

রোকেয়ার বাবা একেবারে গোঁড়া মুসলমান ছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারের মহিলাদের পর্দার আড়ালেই রাখতে চাইতেন এবং শুধুমাত্র কোরান পাঠের জন্য আরবি ভাষা শেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। রোকেয়া ও তাঁর বোন করিমুন্নেসা তাঁদের ভাইদের সাহায্যে ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন, উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া মুসলিম মহিলাদের উন্নতি সম্ভব নয়। রোকেয়ার বোন করিমুন্নেসা তাঁকে আজীবন লেখা ও সমাজসেবার কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। করিমুন্নেসা নিজে একজন কবি ছিলেন। কিন্তু ১৫ বছরে পা দেওয়ার আগেই তাঁর বিবাহ হয়ে যায় এবং তাঁর আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠা হয়নি।

এর পরেই নারী শিক্ষা ও নারী অধিকারের দিকে জোর দেন রোকেয়া, বিশেষ করে মুসলমান মহিলাদের অধিকার নিয়ে। সেই যুগে মুসলিম মহিলাদের একটি 'বস্তু' হিসেবে গণ্য করা হত। যে 'বস্তুটি' সবসময় পর্দার আড়ালে থাকত।

রোকেয়ারও মাত্র ১৬ বছর বয়েসে সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। শাখাওয়াত ১৯০৯ সালে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর, স্বামীর অনুপ্রেরণা ও অর্থ সম্বল করে শাখাওয়াত গার্লস মেমোরিয়াল হাইস্কুল স্থাপন করেন সাবেক পূর্ববঙ্গের ভাগলপুরে (এলাকাটিতে মূলত উর্দু ভাষাভাষী মুসলমানরা বাস করতেন)। কিন্তু স্বামীর পরিবারের সঙ্গে বিষয়-আশয় নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি হওয়ার পর ১৯১১ সালে বিদ্যালয়টিকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন রোকেয়া।

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন ইসলাম (মুসলিম মহিলা সংগঠন) প্রতিষ্ঠা করেন রোকেয়া। এই সংগঠনটি বাঙালি মুসলমান নারীদের জন্য রোকেয়ার অন্যতম অবদান। এই সংগঠনের মাধ্যমে নিপীড়িত মুসলমান মহিলাদের আর্থিক সাহায্য ও শিক্ষাদান করতেন রোকেয়া। সবচেয়ে বড় কথায়, এই সংগঠনের মধ্য দিয়েই রোকেয়া মুসলমান মহিলাদের অধিকার ব্যাপারে জনমত গঠন করতেন।

তাঁর স্কুলের পঠন পাঠনের পদ্ধতি থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। রোকেয়া নিজের সময় থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তাঁর স্কুলে মেয়েদের শরীরচর্চা ও পেশাদার বিষয়গুলোর উপর শিক্ষা দেওয়া হত যাতে মহিলারা আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারেন। 'মানসিক দাসত্ব' বলে একটি শব্দ তৈরি করেন। এই মানসিক দাসত্ব তো এই যুগেও রয়েছে।

body_032318115635.jpgআজও কিন্তু রোকেয়ার অবদান তাঁর সুলতানার স্বপ্নের মতই ফিকে

১০০ বছর আগে রোকেয়া তার প্রতিপক্ষদের যুক্তি ও রসিকতা দিয়ে যে কথা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। আজকের দিনেও যা খাটে। একই ভাবে, মুসলমান পুরুষদের অহংবোধকে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে হাতিয়ার করে সেই অহংবোধে আঘাত হানতে পেরেছিলেন রোকেয়া। তাঁদের কখনোই সোজাসুজি উদারনীতির কথা শুনিয়ে ক্ষেপিয়ে দেননি।

এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, "মহিলাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু না করার খেসারত দিতে হচ্ছে মুসলমান সমাজকে। একটি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে উচ্চবংশের মুসলমান তরুণরা নাকি পণ করেছেন যে শিক্ষিত মুসলমান মহিলারা ছাড়া তাঁরা বিবাহ করবেন না। এই তরুণরা হুমকি দিয়েছেন যে শিক্ষিত মুসলমান মহিলা না পেলে তারা নাকি খ্রিস্টান মেয়েদের বিবাহ করতেও প্রস্তুত।"

সমালোচকরা এই ধরণের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু সত্যিটা অস্বীকার করতে পারবেন না। এখনও মুসলমান ঘরে জন্মানো মানে মহিলাদের অধিকার খর্ব হওয়াটাই নীতি। সেই সময়কার সামাজিক অবস্থানের কথা মাথায় রেখে একটা কথা বলা যেতেই পারে - এই ধরণের পদক্ষেপই সেই সময় একমাত্র উপায় ছিল।

১৯২৬ সালে বাংলার মহিলা শিক্ষা অধিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। সে সময় তিনি বলেছিলেন, "আমি কৃতজ্ঞ যে আপনারা আমাকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু আমি নিজেকে এর যোগ্য বলে মনে করি না। সারা জীবন ধরেই আমাকে পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই তো আমি সমাজের সঙ্গে মিশতে পারিনি। সমাজে মিশতে না পেরে আমার অবস্থা এমনই যে এই সম্মেলনে আপনারা আমার কাছ থেকে ঠিক কী চান, সে সম্পর্কে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। এ বার আপনারা ঠিক করুন যে আমার এই বক্তব্য শুনে আপনার হাসবেন নাকি কাঁদবেন।"

অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। তাঁর দুই সন্তানও বাল্যকালে মারা যায়। এত কিছুর পরেও তাঁকে শুধু সমালোচনাই শুনতে হয়নি, সমাজ তাঁকে একঘরেও করে রেখেছিল। তবে সেই পরিস্থিতিতেও তিনি কোনও ভয়কে তোয়াক্কা না করে বাঙালি মুসলমান মহিলাদের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন।

১৯৩২ এর ৯ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঠিক তার আগের রাতে প্রায় ১১টা অবধি তিনি কাজ করছিলেন। "নারীর অধিকার" নামক একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। সেই সময় একজন মুসলমান নারী হয়েও মুসলমান নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার তার যে প্রয়াস তা কিন্তু জনমানসে প্রচার পায়নি। আজও কিন্তু রোকেয়ার অবদান তাঁর সুলতানার স্বপ্নের মতই ফিকে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMAN QUAZI SUMAN QUAZI @suman_quazi

Suman Quazi is a Mumbai-based writer, feminist and cat-whisperer.

Comment