আবার ফিরে আসবে বাংলাব্যান্ডের সেই সোনালি দিনগুলো
বাংলা ব্যান্ডের জন্য দুঃখ করার কারণ নেই, নতুন নতুন ব্যান্ডের মঞ্চে প্রবেশ এই হল বলে
- Total Shares
উফ! সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকের শেষের কথা বলছি। সেই সময় প্রতিদিনই যেন একটা করে নতুন বাংলা ব্যান্ড সৃষ্টি হত। স্কুলে, কলেজে কিংবা পাড়াতে গান-বাজনা করনে-ওয়ালা বন্ধু-বান্ধবরা সুযোগ পেলেই বাংলা ব্যান্ড তৈরি করে ফেলছিল। কখনও পরিচিত ব্যান্ডগুলোর চেনা গান গাইত আবার কখনও একেবারে আনকোরা নতুন গান তৈরি করা হত। এই নতুন নতুন ব্যান্ডগুলো যে কয়েকটি অনবদ্য কাজ করেছিল, তা স্বীকার করে নিতেই হবে।
এই ব্যান্ড সৃষ্টির পিছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে নিজেদের প্রতিভাকে দর্শকদের সামনে মেলে ধরবার প্রচুর সুযোগ ছিল। পাড়ার সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বড় বড় মঞ্চে অনুষ্ঠিত হওয়া সঙ্গীত সন্ধ্যা - সর্বত্রই ব্যান্ডের ক্রেজছিল চোখে পড়ার মতো। একগাদা এফএম চ্যানেল তখন খুলে গেছে। এবং প্রতিটি এফএম চ্যানেলে ব্যান্ডের গান রমরম করে বাজানো হত। টেলিভিশন পর্দা জুড়ে তখনব্যান্ডের গান কিংবা ব্যান্ড সদস্যদের নিয়ে টক শো। সব মিলিয়ে বাংলায় ব্যান্ড সংস্কৃতি তখন মধ্য গগনে।
সঙ্গীত বাংলা চ্যানেল তখন 'ব্যান্ডে মা-তারম' বলে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। এই অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র নতুন নতুন ব্যান্ডকে প্রতিভা দেখানোর সুযোগ করে দেয়নি, বাংলা ব্যান্ড তখন এতটাই লোকে শুনত যে চ্যানেলটির টিআরপিও হুহু করে বেড়েছিল।
বাংলা ব্যান্ডের সূত্রপাত অবশ্য তার বছর তিরিশ আগে। পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁগুলোতে তখন ইংরেজি ব্যান্ডের আধিপত্য। কতকটা সেই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্তরের দশকে আমার বাবা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) তার ভাইদের ওকয়েকজন প্রতিবেশীদের নিয়ে 'মহিনের ঘোড়াগুলি' নাম একটি ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ব্যান্ডের সেই পথ চলা শুরু। 'মহিনের ঘোড়াগুলি' ১৯৮১ সালের পরে বন্ধ হয়ে যায়। বাবার মনে হয়েছিল যে যাঁদের জন্য এই ব্যান্ড সৃষ্টি হয়েছেসেই সাধারণ দর্শকরাই অনুষ্ঠান দেখতে আসছেন না।
সত্তরের দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় 'মহিনের ঘোড়াগুলি' প্রতিষ্ঠা করেন
তবে বাংলা ব্যান্ডের উপর মহিনের ঘোড়াগুলির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর পরেই বাংলা ব্যান্ডের জোয়ার লক্ষ করা যায়। 'নগর', 'ফিলোমেল', দেবজ্যোতি মিশ্রের 'বাইসাইকেল', 'এক্কা' 'হ্যামিল্টনের বাঁশিওয়ালা' একে একে সৃষ্টি হল, আর বাঙালির মননে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিল।
'মহিনের ঘোড়াগুলি' বন্ধ হয়ে গেলেও গানগুলো কিন্তু বেঁচে ছিল। নব্বইয়ের মাঝমাঝি বাবা এক ঝাঁক নতুন প্রতিভাদের সঙ্গে নিয়ে 'মহিনের ঘোড়াগুলি'র গানের সম্পাদিত অ্যালবাম শুরু করলেন। 'আবার বছর কুড়ি পর' (১৯৯৫),'ঝরা সময়ের গান' (১৯৯৭), 'খেপার গান' (১৯৯৮) - এই সব বিখ্যাত অ্যালবামগুলো তো তখনই তৈরি হয়েছিল।
বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে সেই সময় আরও একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। ১১৯৫ সালে তৈরি হয়েছিল বাংলা ব্যান্ডের প্রথম হিট গান - 'পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে'।
নব্বইয়ের শেষে তো বাংলা ব্যান্ডের সোনার সময়
বাবার এই 'কামব্যাক ইনিংসের' আগেই অবশ্য 'অভিলাষা', 'ক্যাকটাস', 'চন্দ্রবিন্দু' ও 'পরশ পাথর' তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ৯৫ সালে 'লক্ষীছাড়া'র পথ চলা শুরু 'মহিনের ঘোড়গুলির' সম্পাদিত গান দিয়ে। আর নব্বইয়ের শেষে তো বাংলা ব্যান্ডের সোনার সময়। 'ফসিল' তৈরি হল, এর পর এল 'ভূমি'।
পরবর্তী সময় অবশ্য কিছুটা ভাঁটার টান লক্ষ করা গিয়েছিল বাংলার ব্যান্ড সংস্কৃতিতে। এফএম স্টেশনগুলো ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ফিল্মি গানের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছিল। নন ফিল্মি গান প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল মেনস্ট্রিম মিডিয়া।
তবে, আমার স্থির বিশ্বাস, এতে ব্যান্ডের দাপট কমান যাবে না। বাংলা ব্যান্ড আবার স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করবে। নতুন নতুন ব্যান্ড আবার উঠে আসবে। 'ব্লাড' 'ক্রসরোডস' 'জ্যাকর্যাাবিট' তো বেশ ভালোই করছে। আমার বন্ধু দেবাদিত্য (চৌধুরী) ও 'ফসিলস'এর রূপম ইসলাম বাংলা ব্যান্ড নিয়ে একটি পত্রিকা বার করছে।
একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতেই পারে, আমাদের নতুন ইউটিউব জেনারেশন এক কথায় অতুলনীয়। আমি নিশ্চিত অল্প কিছুদিনের মধ্যে এদের মধ্য থেকে অনেক নতুনপ্রতিভা উঠে আসবে।যারা বাংলা ব্যান্ড ভালোবাসেন তাঁদের দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আপনাদের বিনোদন জোগাতে নতুন নতুন ব্যান্ডের মঞ্চে প্রবেশ এই হল বলে।

