উপযুক্ত উত্তরসূরির অভাবে হারিয়ে যেতে পারে হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি

১৯৮৮ তে এই জুটির প্রথম প্রদর্শনী কলকাতার উৎরাম ক্লাবে

 |  3-minute read |   21-04-2018
  • Total Shares

আমাদের জুটির নাম ছিল 'অমর-সব্যসাচী।' তাই আগে অনেকেই মনে করতেন যে অমর-সব্যসাচী বোধহয় একজন ব্যক্তির নাম, যাঁর নাম অমর আর পদবী সব্যসাচী। আমরা যখন মঞ্চে হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি দেখাতাম তখন আমাদের দু'জনের মধ্যে বোঝাপড়া এমন পর্যায়ে ছিল যে অনেক সময় দর্শক বুঝতেই পারতেন না, যে আকৃতিগুলো ভেসে উঠছে তার পেছনে আসলে রয়েছে দু'টো মানুষের চারটে হাত। দীর্ঘ ৪৩ বছরের 'পার্টনারশিপ' আমাদের। মঞ্চে কেন, জীবনে কখনও আমাদের তাল কাটেনি।

১৯৮৮ তে এই জুটির প্রথম প্রদর্শনী কলকাতার উৎরাম ক্লাবে। তারপর ক্রমশ সর্ব ভারতীয় হতে হতে বিশ্বেও নানা প্রান্ত থেকে ডাক আসতে শুরু করে। এরপর ১৯৯৭ সালে যাই ওমানের মাস্কটে। বিদেশের মাটিতে এটাই আমাদের প্রথম শো ছিল।

amar_body1_042118015304.jpgঅমর সেন

২০১২ সালে কলকাতা বইমেলা, আমাদের একটা অডিও-ভিডিও দিয়ে উদ্বোধন করা হয়। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নির্বাক’ ছবির টাইটেল সিকোয়েন্সে আমাদের হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি দর্শকদের খুব ভালো লেগেছিল। হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফারের পাশাপাশি সব্যসাচী ছিলেন একজন জাদুকরও। প্রকৃতপক্ষে একটি জাদুর আসরে আমার ওঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। উনি আমার চেয়ে সামান্য বড় ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই উচ্চ রক্তচাপ ও সুগারে ভুগছিলেন। ২০০৯ সালে সব্যসাচী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তারপর প্রায় তিন বছর উনি কাজ করতে পারেননি। দেশবিদেশ মিলিয়ে তখন আমাদের হাতে ছিল অনেকগুলো অনুষ্ঠান। তাই তখন সব্যসাচীকে ছাড়াই আমাকে শোগুলো করতে হয়েছিল।

হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন কাজ না করতে পারার ফলে সব্যসাচী একরকম ভেবেই নিয়েছিলেন যে উনি বোধহয় আর মঞ্চে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু আমিও ঠিক করি যে মঞ্চে ওঁকে ফেরাবই। তাই একরকম জোর করেই আমি আবার ওঁকে মঞ্চে ফেরাই এবং তারপরে আমরা জার্মানি ও দোহায় শো করি। কিন্তু তিনি যে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন সেটা কখনও কল্পনা করতে পারিনি। ২০১৬ সালে সব্যসাচী সেন মারা যান।স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে ভেবেছিলেন হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি বোধহয় সংকটে পড়ল। কিন্তু কথায় আছে না, দা শো মাস্ট গো অন।

আবার শো শুরু করি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। তবে আজও মঞ্চে আমি ওঁকে আমার পাশে অনুভব করি।

amar_body2_042118015344.jpgহাত ও তার ছায়ার মায়া

শুধুমাত্র হাত আর আঙুলের ছায়া দিয়ে বাঘ, হাতি, হরিণ, পাহাড়, নদী থেকে বাড়িঘর পর্যন্ত যে তৈরি করে তোলা সম্ভব, তা এই হ্যান্ড শ্যাডোওগ্রাফি না দেখলে লোকে বিশ্বাসই করে উঠতে পারবেন না। কখনও নানা বয়সের মানুষের মুখাবয়ব, তার উপরে আবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা, একটা গাছ, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেব, শুধু হাতের ছায়ার কারসাজিতে। হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফিকে কী ভাবে কম্পিউটার লেয়ারিং ও হাতের ছায়ার মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটা অন্য মাত্রায়ে নিয়ে গেল আমার ছেলে অর্ক সেন। ঠিক এ ভাবেই তৈরি করা হল মধ্যপ্রদেশ সরকারের পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপনটি - এমপি আজব হ্যায়। পরে এই বিজ্ঞাপনটি ২০১০-এ সেরা উদ্ভাবনী বিজ্ঞাপন হিসেবে স্বীকৃতিও পায়। এছাড়াও তৈরি করা হয় লেট ক্যালকাটা সারপ্রাইজ ইউ বিজ্ঞাপনটি তথা অন্যান্য এ ভি বিজ্ঞাপন।

ভারত তো বটেই, বিশ্বে আমার ও সব্যসাচীর এই শিল্পকলাটি পরিণত মনস্ক বিনোদন হিসেবে এবং একটা নতুন 'সিরিয়াস' মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে আরম্ভ করল। উপযুক্ত উত্তরসূরি না থাকার ফলে প্রসার ঘটার আগেই হয়ত এই শিল্প হারিয়ে যেতে পারে। তবে এই শিল্পটা যাতে প্রসারিত হতে পারে, সেই তাগিদেই আমি অ্যাকাডেমি অফ ম্যাজিক্যাল আর্টস অ্যান্ড রিসার্চ নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করি।

গত তিন বছর ধরে ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ম্যাজিক এসোসিয়েটস (ফিমা)-র উদ্যোগে কলকাতায় কিছুদিন আগেই হয়ে গেল ম্যাজিক ফেয়ার বা জাদুমেলা। মোহরকুঞ্জে এই চতুর্থ জাদুমেলায় আমিও ছিলাম। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিলেন ছোটবড় অনেক জাদুকর, জাগলার, কথাবলাপুতুল, স্যান্ড অ্যানিমেশন, হাতের ছায়া, পাপেট্রি ও আরও অনেক এই ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা। আমি মনে করি যে এই ধরনের উদ্যোগ বর্তমান প্রজন্মকে, এই জাতীয় শিল্পকলার প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Amar Sen Amar Sen

Hand shadowgrapher

Comment