কার্যত একরঙা নোট, দেশের বিপুল ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যের ছাপই নেই এ দেশের টাকায়
দেশের বিপুল বর্ণময় ঐশ্বর্য্য ছাপা হলে আমাদের দেশের নোটগুলি সুন্দর দেখতে হবে
- Total Shares
নোট বাতিল নিয়ে দেড় বছর ধরে বিস্তর হইচই হয়ে চলেছে। নোট বাতিল ঠিক না ভুল, কালো টাকা উদ্ধার হল কি হল না, আগামী লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী কতটা সমস্যায় পড়বেন কিংবা নোট বাতিলের প্রভাব উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে কেমন পড়েছিল...।
বাজারে নতুন নোট এল, ২০০০ টাকা আর ৫০০টাকার। রটে গেল ২০০০ টাকার নোটের মধ্যে এমন একটি মাইক্রোচিপ আছে, নোট লুকিয়ে রাখলেই স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী তার সন্ধান পেয়ে যাবেন। জল লাগলেই নোটটির রং উঠে যাবে, আবার দীর্ঘ দিন নোটটি ব্যবহার না করলেও তার রং ফিকে হয়ে যাবে। হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরতে লাগল ২০০০ টাকার নোট কেটে চিপ বার করার ছবি। যিনিই পেরথম সেটি বানিয়ে থাকুন, কাজটি অসাধারণ ছিল, তারিফ না করে উপায় নেই। তারপরে এল ৫০০ টাকার নোট। লোকে বলাবলি শুরু করে দিলেন, এটি ধুপের টাকার মতো, অত্যন্ত খেলো, বেশিদিন টিঁকবে না। ৫০ টাকার নোটের হালকা রং নিয়েও কত কথা! ২০০ টাকার নোট আসার আগেই মোটামুটি সব আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ, নতুন নোট হাতে পাওয়ার উত্তেজনাও আর নেই। নতুন ১০ টাকার নোটের প্রবেশ ঘটল নিঃশব্দেই।
টাকা নিয়ে তো অনেক কথাই হল, কিন্তু তার সৌন্দর্যের কথাটাতো কেউ বললেন না! নতুন যে কটা নোট এসেছে, ২০০০ টাকার নোটটি বাদে, প্রতিটি নোটেই এমন এক সৌধ বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের ছবি আছে, যার পরিচয় দেওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু সেখানে নতুনত্ব কতটা আছে? ব্রিটিশ ঘরানার নোটের বাইরেই বা এখন কতটা বেরোতে পারল আধুনিক ভারত? সেই কার্যত একরঙা নোট, তাতে জালিয়ায়াতি আটকানোর নানা উপায় এবং ফল হিসাবে আসল নোট বার হওয়ার সপ্তাহ-কাল শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল নকল নোটের আতঙ্ক।
নতুন নোট এল ঠিকই, তাতে নতুন কয়েকটি সৌধ আছে ঠিকই, কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই সংসদ ভবন আর কোণার্কের চাকা চলে এল। গুপি গাইন বাঘা বাইনের রাজার ঢঙে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, নিদর্শন কি কম পড়িয়াছে?
ঘুরে ফিরে একই জিনিস এসেছে এ দেশের নোটে
আমরা অন্য ভাবে ভাবতে পারি না? ঐতিহ্য মানে কি শুধুই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন? উত্তরটা কি এখনও ভাবার সময় হয়নি? বিশ্বের কয়েকটি নোটের সঙ্গে পরিচয় করা যাক। ধরুন ভেনেজুয়েলা। তেলের জন্য ভারত অনেকটাই দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশের উপরে নির্ভরশীল। সেই দেশের নোটের ওরিয়েন্টেশনখানি দেখুন, একদিক উল্লম্ব, অন্য দিকটি আনুভূমিক।
ভেনেজুয়েলার কাগুজে টাকা, একদিক উল্লম্ব, অন্য দিন আনুভূমিক
নীচে সিরিয়ার নোটটিকে দেখুন, খুব একটা কিছু বলার দরকার নেই। পুরানিদর্শন ওরাও চেপেছে, একেবারে অন্য ভাবে। তা ছাড়া ভেনেজুয়েলা বলুন বা সিরিয়া, নোট দুটিতে রঙের যে বাহার রয়েছে, আমাদের দেশের নোটে সেই বর্ণময়তা কোথায়? নোটে অনেক রকম রং ব্যবহার করলে তা ছাপার খরচ আকাশ ছোঁবে কিনা, সে ব্যাপারে অবশ্য কোনও ধারনা আমার অন্তত নেই। একটা বলে রাখা দরকার, ছাপার খরচ খুব বেশি হলে বাংলাদেশের পক্ষে ২ টাকার সুন্দর নোট বার করা হয়তো মুশকিল হত।
সিরিয়ার নোট, পুরানিদর্শন রয়েছে অন্য আঙ্গিকে, আকর্ষণীয় ভাবে
বাংলাদেশের নোট
বারমুডার নোটে বহু রঙের ব্যবহার
প্রশ্ন হল ভারত কী করতে পারে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জনপদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, নাচ-বাদ্য আছে, রংবেরঙের পোশাক আছে। ভারতে ২,৫৪৬ রকমের মাছ, ১,২৫০-এর বেশি প্রজাতির পাখি, অন্তত ১৯৭ রকমের উভচর, ৪০৮ প্রজাতির সরিসৃপ, ১৫,০০০ প্রজাতির ফুলের গাছ রয়েছে। ভারতে পাওয়া জীবাশ্মের সংখ্যাও বড় কম নয়। তা ছাড়া হিমালয়, পশ্চিমঘাট পর্বত, মরুভূমি, সমুদ্র, দ্বীপপুঞ্জ ও বহু অরণ্য রয়েছে। এই সব অরণ্যে বাঘ-হরিণ-একশৃঙ্গ গণ্ডার-হাতি-সিংহের মতো স্তন্যপায়ীর সংখ্যাও কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো ভয়ঙ্কর সুন্দর বাঘ রয়েছে এ দেশে। সেই সব রং যদি টাকায় দেখা যেত কেমন হত? সরকার বাহাদুর একবার ভেবে দেখতে পারেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সংসদ ভবন আর কোণার্কের রথের চাকার বদলে দেশের বাকি ঐশ্বর্য্যের এক কণা টাকায় রাখা যায় কিনা।
সবকটি নোটের নম্বর মুছে দেওয়া হয়েছে