কৃষকদের জন্য প্রথম লড়াই ছিল এ দেশে রাজনৈতিক সংবাদের জনক হরিশ মুখার্জির

যিনি সত্যিই কৃষকদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, তাঁর বাড়ি ভেঙেছে বামপন্থীরাই

 |  4-minute read |   23-04-2018
  • Total Shares

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম ভারতীয় সাংবাদিক, যিনি এই দাবি তোলেন যে ভারতবর্ষীয় সমস্ত সমস্যার সমাধান ভারতবাসীকেই করতে হবে। তিনি দাবি করেন যে, ভারতে এখনই স্বায়ত্তশাসন চালু করা দরকার।

কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হত তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্র। তিনি এই সংবাদপত্র সম্পাদনা করেছেন ১৮৫৬ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত। হরিশচন্দ্রের মতামতকে তখন বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিতেন ব্রিটিশ শাসকরা। তৎকালীন সরকার তাঁকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে প্রতি বৃহস্পতিবার যখন তাঁর ভবানীপুরের বাড়ি থেকে সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হত, তখন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ওঁর বিশেষ দূত পাঠিয়ে দিতেন। তিনি কার্যত ছাপাখানা থেকেই হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্রের একটি কপি তুলে নিয়ে যেতেন ক্যানিংয়ের কাছে।

উনবিংশ শতাব্দীর যে নবজাগরণের কথা আমরা বলে থাকি, তার অনেক সমালোচক। যাঁরা মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই মনে করেছেন যে, এই নবজাগরণ কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি ওঁদের বিরোধিতা সময় সময় যা আক্রমণে পর্যবসিত হয়েছে। তবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন দরিদ্র এবং কঠোর সংগ্রাম করে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন নিজের ক্ষমতায়। সেই মানুষ নীলবিদ্রোহের সময় চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। তাঁর সেই লড়াইয়ের অস্ত্র ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্র।

body_042318010325.jpgনীলকুঠি (ছবি সৌজন্য:উইকিপেডিয়া)

হিন্দু পেট্রিয়টকে ব্রিটিশরা ভয় পেত অনেক বেশি, কারণ এটা ইংরেজিতে লেখা, একটা-দুটো কপি ইংল্যান্ডে চলে গেলে সে দেশের মানুষ সত্যটা জেনে ফেলবে, তখন সরকার বিব্রত হবে।

সম্ভবত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ই এ দেশে প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক, যিনি বিভিন্ন জায়গায় সংবাদদাতা বা করেসপন্ডেন্ট রেখেছিলেন। যশোহরে তাঁর সংবাদদাতা ছিলেন শিশিরকুমার ঘোষ। বিভিন্ন জায়গার সংবাদিকরা তাঁকে চিঠি পাঠাতেন, যা থেকে তিনি নীলকরদের সম্বন্ধে জানতে পারতেন এবং খবর করতেন। এটা এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, ওঁর বাড়িতে তখন সারাদিনই অত্যাচারিত, উৎপীড়িত চাষিরা এসে ওঁর বাড়িতেই থাকতেন, সেখানেই তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হত। এঁদের কারও বসতবাটি হয়তো কেড়ে নিয়েছে সরকার। ভিটেমাটি ছাড়া ওই কৃষকরা জানতেন যে এই মানুষটিই আমাদের জন্য লড়াই করছেন।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। সারা জীবন কাজ করে গিয়েছেন গ্রামের সেই সব মানুষের স্বার্থে, মার্কসীয়রা যাঁদের সর্বহারা বলেন। সেই সর্বহারা চাষিদের সঙ্গে তিনি কতটা ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছিলেন এবং তাঁরাও তাঁকে কতটা ভালোবাসতেন নিজেদের লোক বলে তা বোঝা গেল তাঁর মৃত্যুর পরে।

এক লোককবি গান বাঁধলেন, তাঁর গানের মধ্যে ফুটে উঠল হা-হুতাশ:

নীলবাঁদরে সোনার বাংলাকরলে এ বার ছারখারঅসময়ে হরিশ মলোলঙের হল কারাগার।

এই যে লোকমাধ্যমের মধ্যে এই মানুষটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। চাষিরা তাঁকে নিজের লোক বলে মনে করতেন।

যথার্থ ভাবে বলতে গেলে, ভারতে রাজনৈতিক সংবাদ প্রথম শুরু করেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এর আগে একেবারে ছিল না তা নয়, সমাজ সংস্কারের রাজনীতি ছিল। রামমোহন রায় তাঁর সংবাদপত্রগুলি চালিয়েছিলেন সমাজ সংস্কারের পথেই। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী ইংরেজি সংবাদপত্রে সামান্য ভাবে দুঃখ ও অভাব-অভিযোগ জানানো হয়েছে। এমন কথাও জানানো হয়েছে এ দেশীয়দের চেয়ে কম যোগ্যতার ‘সাদা চামড়ার লোক’কে চাকরিতে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র সম্বন্ধে ওঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে, কিন্তু এগুলো ইঙ্গিতে, সবই ছিল আবেদন-নিবেদন।

হরিশচন্দ্রই প্রথম সুস্পষ্ট উচ্চারণ করলেন যে, রাজনীতি জীবন বাদ দিয়ে নয় এবং রাজনৈতিক সাংবাদিতকা প্রথম প্রচলন করলেন যখন উনি প্রচার করলেন, স্বায়ত্তসাসন ভারতীয়দের অধিকার এবং যা কিছু ভারতীয়দের সমস্যা, তা সমাধানের ভার ভারতীয়দের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে সমাধানের জন্য। এ জন্য তিনিই ভারতে প্রথম রাজনৈতিক সাংবাদিকতার উদ্গাতা।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এবং ভূমিহীন কৃষকের (যাঁদের অনেকে প্রোলেতারিয়ত বলে থাকেন) সঙ্গে যিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, তাঁদের জন্য তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল। তিনি তাঁর এই শ্রেণীর বেড়াটা ভেঙে ফেলে মানুষের স্বার্থটাকেই নিজের স্বার্থ করে তুলেছিলেন।

তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। (তখনকার দিনের খানিকটা রীতি মেনে) তিনি পানাসক্তও ছিলেন। পরিবারে অশান্তিও ছিল। সব মিলিয়েই তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।

দুঃখের কথা হল, বাঙালি তো আত্মবিস্মৃত জাতি, তাই ওঁর একটা ছবিও পাওয়া যায় না। উনি কেমন দেখতে ছিলেন, তা জানার উপায় নেই। আরও দুঃখের বিষয়, ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোডে ওঁর যে বসত বাড়িটা ছিল, সেটা একসময় ঐতিহ্যবাহী ভবন বা হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের তালিকায় ছিল। কিন্তু পরে রাজনীতির নানা কারণে ওই ভবনটিকে ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে এখানে যে উনি থাকতেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। ওই বাড়িটি ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখেছি যে ওই বাড়িতে ফলক লাগানো ছিল যে এই বাড়িতে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বসবাস করতেন।

যাঁরা বামপন্থী মনোভাবাপন্ন, যাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট বলে দাবি করেন, যাঁরা চাষিদের স্বার্থ দেখেন, তাঁরা সেই মানুষের স্মৃতিটাই ধ্বংস করে ফেললেন, যিনি সত্যিই কৃষকদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় সেই মানুষটির স্মৃতিরক্ষায় কিছুই করা হয়নি।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUBIR GHOSH SUBIR GHOSH

Principal, Bhavan's College of Communication and Management, Bhawanipur

Comment