সাংস্কৃতিক বন্ধনেই দৃঢ় হতে পারে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

রাষ্ট্রের সীমানা ভাগ হলেও সংস্কৃতি বদলায় না , তা প্রবহমান থাকে যুগ যুগ ধরে

 |  6-minute read |   16-04-2018
  • Total Shares

বাংলা নববর্ষ এবারও প্রমাণ করল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে স্থায়ী ভিত্তি দিতে সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ দু‘দেশের।

কাঁটাতারের বেড়া দু’দেশকে বিভক্ত করলেও সাংস্কৃতিক বাঁধন ছিন্ন করতে পারেনি দু‘দেশের একই ধারার সাংস্কৃতিক উৎসব। এ বারও বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের আটটি সীমান্ত এলাকায় পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠিক আগের মতোই।

বাংলাদেশের বর্ষবরণ অবশ্য ভারতের একদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বাংলাদেশিরাও নববর্ষ উদযাপন করেন ভারতের সঙ্গে মিল রেখে। ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে হাজারো মানুষ প্রখর রোদ উপেক্ষা করে তাঁদের প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর, কান্দাইল, বেতনা ডাবরি, কাঁঠালডাঙ্গী, বুজরুখ, ধর্মগড় ও জগদল সীমান্তে।

বাংলাদেশ ও ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনদের মাঝে সৌহার্দ্র্য ও সম্প্রীতি অব্যাহত রাখতে ঠাকুরগাঁওয়ের ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিজিবি ও বিএসএফের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয় দুই বাংলার মিলন মেলা।

body1_041618042033.jpg১৯৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়

মেলায় দুই বাংলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাদের আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের একনজরে দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন কাঁটাতারের বেড়া ধরে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ মিলন মেলা। এ সময় আত্মীয়-স্বজনের জন্য কাঁটাতারের ওপর দিয়ে শুকনো খাবার ও শাড়ি-কাপড় সহ তাদের প্রিয়জনদের জন্য বাড়ি থেকে আনা খাবারসহ নানা উপহার সামগ্রী বিনিময় করেন। কাঁটাতারের বেড়া তাদের আলাদা করে রাখলেও আবেগ তাদের টেনে আনে সীমান্তের কাছাকাছি। ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন ছুটে আসেন এখানে।

স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে সকাল থেকেই দেখার সুযোগ হচ্ছে দু‘দেশের একই সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষের সৌহার্দ্র্য দৃশ্য।

গতকাল বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হওয়া একটি খবর এই উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলিকে এক চিঠি পাঠিয়েছেন শুভেচ্ছা জানিয়ে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত। সুষমা স্বরাজ দু'দেশের সাংস্কৃতিক ঐক্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের অভিন্ন শিল্প, সংস্কৃতি ও সঙ্গীত রয়েছে এবং আমাদের উৎসবগুলো আমরা একসঙ্গে উদযাপন করতে পারি।

সুষমা স্বরাজের কথায় স্পষ্ট, ভারত-বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে রয়েছে নানাবিধ মিল। এ মিল চলে আসছে শত শত বছর ধরে। যার সুত্র ধরেই দু'দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধন জোরালো হচ্ছে। এ সম্পর্ক থেকেই দু'দেশের মানুষ পাচ্ছে একে অপরের থেকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা।

স্বাভাবিক কারণেই ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ককে স্থায়ী ভিত্তি দিতে, সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করার উপর জোর দিতে হবে। এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক সমঝোতা খুব জরুরি, তবে মানুষে- মানুষে সম্পর্ক আরেও বেশি প্রয়োজন।

কেননা, ভারত-বাংলাদেশের মাঝে প্রধান সেতুবন্ধ রচনা করে চলেছে দু’ দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক বন্ধন। দু’ দেশের মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে ভারতের জনগণ বুঝতে পারবে বাংলাদেশের নদীগুলো শুকিয়ে গেলে এ দেশের মানুষের কী পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট পোহাতে হয়। রাজনৈতিক বিরোধ থাকলে এই উপলব্ধি করানো কঠিন। বরং সম্প্রীতি, সহমর্মিতা থাকলেই এটা সম্ভব।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত-রাষ্ট্র পরম মিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে সবসময়। তবে ভারত ও বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকা এবং না থাকা নিয়ে রাজনীতি হয়ে এসেছে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। এরপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ রাজনীতি নতুন মাত্রায় শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক এসব কূটচালের বাইরে গিয়ে দুই দেশের সরকার প্রতিবেশী দেশের মানুষের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টিতে সবসময় সচেষ্ট।

body_041618042126.jpgসরকারের মধ্যে সম্পর্কের পাশাপাশি মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন জরুরি

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে উল্লেখ ছিল দু’দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দু’ দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতি বজায় রাখা হবে এবং পারস্পরিক উন্নয়নে দু’ দেশেই সমভাবে সহযোগিতামূলক আচরণ করবে। সেই সঙ্গে দু’দেশের শিক্ষক, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী ও কলাকুশলী আদান প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে নিয়মিতভাবে। দুই দেশের সরকার নিয়মিতভাবেই পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে এই কার্যক্রম চালিয়ে আসছে গত ৪৬ বছর ধরে। এর আওতায় দুই দেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা সফরসহ নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ভারত সরকার ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে শুরু থেকেই এসব কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরেও সাংস্কৃতিক দলগুলো এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ দুই রাজ্যের বাইরে ভারতবর্ষের মানুষের বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। সেই জায়গায় আমাদের অনেক কাজ করবার রয়েছে।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস ‘ভারত বিচিত্রা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে। এ পত্রিকায় দু’ দেশের কবি-সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশের মাধ্যমে যেমন শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেতুবন্ধ সৃষ্টির প্রয়াস রয়েছে, তেমনি দু’টি দেশের মানুষ, ভূ-প্রকৃতি, দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষের মাঝে দু’টি দেশকে পরিচিত করে তুলবার চেষ্টাও রয়েছে। কবি বেলাল চৌধুরী যখন এ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সে সময় ‘ভারত-বিচিত্রা’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমান সম্পাদক নান্টু রায় পত্রিকাটিকে আরও দৃষ্টিনন্দন ও বিষয়-বৈচিত্র্যে সাজিয়ে তুলেছেন। পত্রিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। যার প্রচার সংখ্যা ২০ হাজার। সম্প্রতি পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনও চালু করা হয়েছে।

এ ছাড়া ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমেও বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস দু’ দেশের শিল্পীদের কনসার্টের আয়োজন করে চলেছে নিয়মিত ভাবে। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি শিল্পীরাই বেশি প্রধান্য পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশকে কাউন্টারপার্ট হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশকে আরও বেশি তুলে ধরতে হবে।

এ কথা সবারই জানা, বর্তমানের বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান এক সময় অবিভক্ত ভারতের অংশ ছিল। গত ৬৭ বছরে এই উপমহাদেশ রাজনৈতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে পাল্টে গেছে তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, সীমানা। মানচিত্র বদলে গেলেও মানুষের জীবনযাত্রা ও তার সংস্কৃতি এত দ্রুত পাল্টায় না। কেননা একই প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি বা কয়েকটি জাতির সংস্কৃতি, রীতিনীতি গড়ে ওঠে শত শত বছর ধরে। তার মধ্যে মিলও থাকে প্রচুর। তাই রাষ্ট্রের সীমানা নতুনভাবে গঠিত হলেও সংস্কৃতির বদল হয় না। তা প্রবহমান থাকে যুগ যুগ ধরে। বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।

এ দু’দেশের রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সীমানা আলাদা হলেও দুইদেশের মানুষের যে সাংস্কৃতিক বন্ধন তা বদলায়নি। বাংলাদেশের মানুষের মতই পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মানুষেরাও বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন। ১৯৪৭ সালে ধর্মকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তানও দু’টি অংশে বিভক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষদের ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরের বছর থেকেই নিজেদের ভূখণ্ডের মানুষদের অধিকার ও সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার সংগ্রামে নামতে হয়। এরই পথ ধরে আসে ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসাবে পাশে দাঁড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সর্বাত্মক সহায়তা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে ভারতীয় সৈন্যদের সহায়তা যুদ্ধে জয়লাভকে ত্বরান্বিত করেছিল।

সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ভারত যতটুকু অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ এখনেও তা করতে পারেনি। সবার আশা, দু’দেশের নানামুখী তৎপরতার মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক দৃঢ়তর হবে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় আরও পরিণতি লাভ করবে। আমি মনে করি, সরকারের মধ্যে সম্পর্কের পাশাপাশি মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন জরুরি। সংস্কৃতির শক্তিই পারে সে বন্ধনকে দৃঢ় করতে। ভারতীয় দূতাবাস এ বিষয়ে সবসময় সহযোগিতা করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারকেও ভারতীয় শিল্পীদের আনার বিষয়ে নিয়মের বেড়াজাল শিথিল করতে হবে।

শুধু বাংলা নববর্ষে নয়, সমধারার সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। উন্নয়নের সম্প্রীতি ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দুটি দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। দুদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিষয়টি জাগ্রত হোক- এটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAHIDUL HASAN KHOKON SAHIDUL HASAN KHOKON @hasankhokonsahi

Bangladesh Correspondent, TV Today.

Comment