ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইতে ইরফান খানের সাহসী দিকটা উঠে এসেছে

“ভালো সময় আমরা নিজের মাকে ভুলে বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের সানিধ্যে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করি”

 |  4-minute read |   21-06-2018
  • Total Shares

২০১১ সালে আকসা সৈকতের ধারে তাঁর নতুন বাড়িতে ইরফান খান ইন্ডিয়া টুডের জন্য আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাঁর ছেলেরা মাঝে মধ্যে ফুটবল খেলে বলে সেই বসার ঘরটাতে আসবাবপত্র তেমন একটা ছিল না। ইরফান খান বলেন, "এনএসডিতে আমাদের সাহসী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছি। অভিনয়ের সঙ্গে সাহসের ঠিক কী যোগ সেটা কোনও দিন বুঝতে পারিনি? এখন বুঝি। একজন অভিনেতা তাঁর ভবিষৎ সম্বন্ধে কিছু স্থির করতে পারে না আর যে মুহূর্তে তিনি সেটা করবেন, তিনি শেষ। সব সময় নিজের বুদ্ধি ও আন্দাজের উপর নির্ভর করতে হবে, নিজেকে মেলে ধরতে হবে এবং ভবিষতে কী ঘটতে পারে সে দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।" একজন দক্ষ অভিনেতা আর তার চেয়েও অনেক উঁচু মাপের একজন মানুষ তিনি, আজ তিনি যখন একটি কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তখন তিনি সেই সাহসেরই পরিচয় দিছেন। তাঁর অসুস্থতাকে ঘিরে নানা গুজুবের অবসান ঘটিয়ে ও সিনেমা জগৎ থেকে দীর্ঘ দিন সরে থাকা নিয়ে তিনি খুব পরিষ্কার একটা বার্তা দিয়ে বলেন, জীবন অতন্ত্য নিষ্ঠু।

তিনি লিখেছেন, "খেলাটা খুব কঠিন। আমি একটা ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম ট্রেনটা খুব জোরে দৌড়াচ্ছিলো। স্বপ ছিল, আকাঙ্খার ছিল, উদ্দেশ্য ছিল, আর আমি তাতে সম্পূর্ণ বুঁদ হয়েছিলাম। হটাৎই আমার কাঁধে কেউ টোকা মারলো আর আমি ঘুরে তাকালাম। টিসি-কে দেখলাম, সে বলল তুমি তোমার গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গেছো। দয়া করে নেবে পড়ো।' আমি একটু বিভ্রান্ততে পড়ি। না না। আমার গন্তব্য এখনও আসেনি। এটাই তোমার গন্তব্য। মাঝে মধ্যে এমনটাই হয়।” একটা দারুন স্মৃতিকথা নাম 'বিং মরটাল: মেডিসিন এন্ড হোয়াট ম্যাটার্স ইন দা এন্ড' বইটিতে অতুল গাওয়ানডে মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, “মানুষ যখন তাঁর জীবনের সীমারেখাটা উপলব্ধি করতে পারে তখন জীবনের কাছে তাঁর আর বেশি কিছু চাইবার থাকে না। তাঁর ধনসম্পদের উপরেও আর তেমন আকাঙ্খা থাকে না। তাঁর আর বেশি ক্ষমতারও দরকার থাকে না। সে যেন তাঁর বাকি জীবনটা ঠিকঠাক করে বাঁচতে পারে, তখন সে এটুকুই চায়। সে যেন কয়েকটা নির্বাচন করতে পারে আর যেসব মানুষ তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখতে পারে।” তাঁর শব্দগুলোর মতোই বেদনাদায়ক ইরফান খানের ছবিটিও। ছবিটিতে ইরফান খান যিনি একটি বিরল ধরণের নিউরোএনডোক্রাইন ক্যান্সারে ভুগছেন তিনি খুব নিশ্চিন্তে একটা সবুজ রঙের খাটে শুয়ে আছেন, একটা বড় তুপি দিয়ে তাঁর মুখের প্রায় অধিকাংশটাই ঢাকা আর তাঁর পা দুটো খাটের উপর ছড়ানো। নিজের সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখে তাঁর বর্তমানের সঙ্গে আপোষ করার চেষ্টা করছেন তিনি, সেটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ও আত্মসমর্পণ করার প্রচেষ্টা করছেন।

অসুস্থতার সবচেয়ে খারাপ দিকটার কথা বলতে গিয়ে অতুল গাওয়ানডে লিখেছেন, এই অবস্থায় একজনের নিজের জীবনের গল্পের উপরে তাঁর কতৃত্ব থাকে না, নিজের গল্প বলতে গিয়ে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিজেকে এবং বাকিদের ইরফান খান এই উপহারটাই  দিয়েছেন, বেঁচে থাকতে গেলে যে দক্ষতা ও নৈপুণ্য লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার প্রয়োজন পরে জীবনের প্রতিবন্ধকতাগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে। অতুল গাওয়ানডের চেয়ে বেশি ভালোভাবে আমি বোধহয় এটা বোঝাতে পারবোনা, “একজন যখন অতুল গাওয়ানডে ও সুস্থ থাকে তখন সে ভাবে সে বুঝি কখনও মরবে না। তখন নিজের কোনও শারীরিক ক্ষমতা খোয়াবার কোনও ভয়েই থাকে না। বাকিরা তখন আপনাকে বলে গোটা পৃথিবীটা তোমার হাতের মুঠোয়, তুমি আকাশ ছুতে পারো, এরম আরও অনেক কিছু।"

irrfan-khan1-copy_06_062118083445.jpg

তখন যেন যা পেয়েছি তাতে কোনও সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না তখন আরও অনেক কিছু দরকার বলে মনে হয়, আরও অনেকগুলো বছর দিতে হবে যাতে আরও অনেক দক্ষতা অর্জন করে জীবনে আরও অনেক কিছু করতে পারি। মন আরও জ্ঞান ও তথ্য সঞ্চয় করতে চায়। তখন তুমি তোমার মাকে বেশি সময় না দিয়ে বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের সানিধ্যে সময় কাটানো বেশি পছন্দ কর।

একজনের যখন আকাশচুম্বি ব্যাপ্তি হয়, তখন মানুষের ম্যাসলোর পিরামিডের সবচাইতে উপরের জিনিসগুলোর পাওয়ার আকাঙ্খা থাকে যেমন কৃতিত্ব, সৃজনশীলতা এবং নিজেকে পরিপূর্ণ করার যাবতীয় সরঞ্জাম। কিন্তু ক্রমশ যখন তার ব্যাপ্তি কমতে থাকে এবং যখন সে তাঁর ভবিষৎটা সীমিত ও অনিশ্চিত বলে মনে হয় তখন তোমার তোমার প্রতিদিনের আনন্দ ও সবচেয়ে নিকট মানুষগুলোর দিকে নজর যায়।” ভারতে এখনও ক্যান্সারের মতো রোগটা তেমনভাবে আলোচিত হয় না, হলেও বন্ধ দরোজার পেছনে খুব ধীরে ধীরে কানে কানে। নিজের অসুস্থতার কথা বলে ইরফান খান তাঁর মতো মানুষ যাঁরা এই রোগে ভোগছেন তাদের এই লজ্জা ও হতাশার ঘেরা টোপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমার খারাপসময় আমি রায়নডি পাউসছ-এর ডা লাস্ট লেকচার পড়ি। "জীবনে তুমি তোমার স্বপ্নগুলো সত্যি করতে পেরেছো কী না সেটাই বড় নয়, বড় কথাটা হল তুমি জীবনটা কী ভাবে কাটাছ।... তুমি যদি নিজের জীবনে ঠিক পথে থাকো তাহলে তোমার কর্মা তোমাকে ঠিক ভালো রাখবে, তোমার স্বপ সত্যি হবে।"

তোমার স্বপ্ন সত্যি হলে তুমি মুক্তির আনন্দ পাবে, যেই মুক্তি আনন্দের কথা ইরফান খান বলেছেন, "জীবনে প্রথমবার 'মুক্তি' কী সেটা উপলব্ধি করলাম। জয়ের আনন্দ পেলাম। জীবনে একটা জাদু আছে সেটা এই প্রথমবার অনুভব করলাম। মহাবিশ্বের উপর আমার বিশ্বাসটা আরও বদ্ধমূল হয়েছে। আমার মনে হয় আমার শরীরের প্রতিটি কোষে তা প্রবেশ করেছে।'' ইরফান খানের শ্রী সুতপা সিকদার যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ মহিলা তিনি আমাকে ইন্ডিয়া টুডের একটা লেখার জন্য ইমেলে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,  "এটা আমরা মেনে নিয়েছি। অন্যরা যা তাঁদের ৩০ বছর বয়সে অর্জন করতে পেরেছি তা ইরফান খান ৪০-এ অর্জন করবে, আর অন্যরা যা তাঁদের ৪০ বছর বয়সে অর্জন করেছে সেটা ওঁ ৫০ বছর বয়সে অর্জন করবে।" তাই আমরা আশা করি একটা কচ্ছপ যেমন অনেক বছর বেঁচে থাকে ঠিক তেমন ভাবেই যেন ইরফান খান অনেক বছর বাঁচে আর যেন প্রমান করতে পারেন যে তিনি সবচেয়ে সুস্থ এক কচ্ছপ।

লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

KAVEREE BAMZAI
Comment