উনিশ শতকের কাঠখোদাই ও লিথোগ্রাফে কলকাতার সমাজচিত্র
কলকাতার বাবু সংস্কৃতি, প্রথম ছাপাখানার উদ্ভব ও সমকালীন ব্লক
- Total Shares
ভিক্টোরিয়া মোমোরিয়াল হলে কী ধরণের নিদর্শন আছে, সে সম্বন্ধে দর্শকদের একটা ধারণা আছে। তাঁরা মনে করেন, এখানে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় চিত্রশিল্পীদের ছবি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল টমাস ড্যানিয়েল ও ইউলিয়াম ড্যানিয়েলের আঁকা ছবি। অন্য ভাবে বলতে গেলে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহের মধ্যে সাহেবিয়ানার ছাপ রয়েছে বলে অনেকের ধারনা। আংশিক ভাবে এ কথা সত্যও বটে।
তবে যেটা অনেকে জানেন না, সাহেবিয়ানার পাশাপাশি আমাদের বিশুদ্ধ খাঁটি স্বদেশী ঘরানা চিত্রশিল্পের বিপুল সংগ্রহ রয়েছে, যাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী শিল্পও বলা চলে। আমরা মাঝেমধ্যে সেগুলো প্রদর্শিত করি বটে, তবে এ বারে আমাদের পরিকল্পনা হল, উনিশ শতক ও বিশ শতকের স্বদেশী চিত্রশিল্প তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে প্রদর্শিত করব। এর মধ্যে একটি প্রদর্শনী বর্তমানে চলছে।ভিক্টোরি্য়া মেমোরিয়াল হলে সম্প্রতি প্রথম পর্বের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে, মূলত উনিশ শতকের এক বিশেষ ধরনের শিল্পসম্ভার দিয়ে। এখানে রয়েছে সেই সময়ের কাঠখোদাই করা ব্লক ও লিথোগ্রাফ। এই প্রদর্শনীতে ফুটে উঠেছে উনিশ শতকের কলকাতার বাবু সংস্কৃতি, প্রথম ছাপাখানার উদ্ভব, ছাপার ক্ষেত্রে নতুন যে প্রযুক্তি আসছে সেই ছবিও। সেই সময়ের ব্লক এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। এক কথায়, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৯ শতকের সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র।
১৮৯৯ সালে কাঠেখাদাইয়ে মহাভারতের দৃশ্য [ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের প্রদর্শনী থেকে]
কাঠখোদাইয়ে বাংলা হরফ, উনিশ শতক [ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের প্রদর্শনী থেকে]
উনিশ শতকের কাঠখোদাই ব্লক। [ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের প্রদর্শনী থেকে]
ভালো ভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এখানে রয়েছে ইংরেজি শিক্ষার আগমন, সেই শিক্ষার সঙ্গে দেশীয় শিক্ষার সংমিশ্রণ, তখন যে সব সামাজিক সংস্কার হচ্ছে এবং সেই সংস্কারের সঙ্গে রক্ষণশীলতারও বিরোধ। বাংলার নবজাগরণের ছাপ সেই সময়ের শিল্পকলাতেও পড়েছিল, তার প্রতিফলন রয়েছে এখানেও।
বাংলা হল ভারতের দর্পনের মতো। সেখানে কী ভাবে একটা নতুন চিন্তাধারা আসছে, সমাজের তার প্রতিক্রিয়া কী, বাবু সংস্কৃতির মধ্য থেকে কী ভাবে শিক্ষিত ভদ্র সমাজের উদ্ভব হচ্ছে – এই গোটা সমাজচিত্রের দর্পন হিসাবে আমরা ১৯ শতকের কাঠখোদাইয়ের প্রদর্শনী করছি।
আমদের এই প্রদর্শনীতে আকারপ্রকার গ্যালারির অসিত পালের সংগ্রহও রয়েছে। সেখানে বেশির ভাগই আসল, আমরা ক্যালিগ্রাফির বিবর্তনও দেখিয়েছি, অর্থাৎ লিপির বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। আসল ব্লকও রয়েছে। এর মধ্যে মিষ্টি তৈরির ছাঁচও রয়েছে।
শিল্পের কোনো গণ্ডী নেই, তাই তা যে সবসময় ড্রয়িংরুমে করতে হবে, এমন কথা নেই। শিল্পের নান্দনিক প্রকাশ যে কোনও মাধ্যমেই যে ঘটতে পারে তার একটি উদাহরণ হল এই মিষ্টি তৈরির এই কাঠের ব্লক। গয়নাবড়িতেও তো শিল্পের বিকাশ দেখা যায়।
সময়ের বিচারে আমরা আরেকটু এগিয়ে যাব দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে। তখন উনিশ শতকের একেবারে শেষে, মোটামুটি ভাবে ১৮৯০-এর দশক থেকে ১৯৩০ সাল অবধি, যাকে আমরা বলি বেঙ্গল স্কুল, তার প্রদর্শনী করা হবে। এই প্রদর্শনীর প্রধান দুই নায়ক হবেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এঁদের দুর্লভ সব ছবি রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহে। এ ছাড়া রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি থেকে আমরা দুর্লভ সব ছবি পেয়েছি। সেগুলো নিয়ে এই বেঙ্গল স্কুল অর্থাৎ উনিশ এবং বিশ শতকের সন্ধিক্ষণ এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের প্রদর্শনীর আয়োজন হবে। চিত্রশিল্পে বেঙ্গল স্কুলের মাধ্যমে প্রথম যে আধুনিকতার আন্দোলন, সেই প্রদর্শনী আমরা করব দ্বিতীয় পর্বে, জুন মাসে।
এই প্রদর্শনী শেষ হলে তৃতীয়পর্বে আমরা করব অলিয়োগ্রাফ, অর্থাৎ ক্যালেন্ডার আর্ট এবং বিশ শতকের প্রিন্ট বা ছাপাই শিল্প। চোরবাগান প্রভৃতি স্থানে এই ধরনের প্রিন্ট হত-- ক্যালেন্ডার, তাস, ডায়েরি প্রভৃতি। এটা দিয়েই শেষ হবে তিনপর্বে বিভক্ত এই প্রদর্শনী। আমরা দেখাতে চাই, সাহেবি শিল্পের পাশাপাশি আমাদের এই সংগ্রহও কোনও অংশে কম নয়।
তবে একটি দরকারি অধ্যায় বাদ থাকছে, তা হল কালীঘাটের পটচিত্র। কালীঘাটের পট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ২০১১ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সঙ্গে যৌথ ভাবে এই প্রদর্শনী করেছিলাম। সেই কারণেই নতুন করে আর কালীঘাটের পটশিল্প প্রদর্শিত হচ্ছে না।
তিন পর্বে আমরা স্বদেশি শিল্পকলা তো দেখাচ্ছিই, তার সঙ্গে নিজেরাও দেখে নিচ্ছি, আগামী বছর ভিক্টোরিয়া মোমোরিয়াল হলের আধুনিকীকরণ শেষে আমরা এই অস্থায়ী প্রদর্শনী থেকে কোনগুলো স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত করব।

