পঁচিশে বৈশাখ নতুন মালা পরেন রবি, সারা বছর তা শুকোয়

উনি থাকবেন, হয়তো আমরা যে ভাবে চাই সেই ভাবে নয়

 |  3-minute read |   08-05-2018
  • Total Shares

পঁচিশে বৈশাখ কাছে এলেই আমার কেমন যেন ভয় করতে থাকে, অসহায় বোধ করি। সারা বছর জুড়ে ধূলো পড়ে, মাকড়সার জাল জমে থাকা রবীন্দ্র রচনাবলির মতোই রাজ্য-জোড়া রবি ঠাকুরের মূর্তি পরিষ্কার করে, পুরোনো শুকনো মালা সরিয়ে টাটকা নতুন মালা পরাবার দিন এটা। অথচ বারোমাস ধরে আমাদের ট্র্যাফিক সিগন্যালে মোড়ে মোড়ে বাজে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কবিগুরু ধূপকাঠি থেকে কবিগুরু চাউ-এর দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকি আমরা। গায়ের টি-শার্ট অথবা ঝোলা পাঞ্জাবিতে জ্বলজ্বল করে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ!’ পণ্যায়নের যুগে রবীন্দ্রনাথ, আজ রবীন্দ্র-সংস্কৃতির এক আদর্শ বাঁচিয়ে রাখা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরই যেন শুধু।

ভোর থেকেই মাইক বাজিয়ে শুরু হয়ে যায় শহরের বীভৎস উল্লাস- নতুন নতুন সুর ও এক্সপেরিমেন্টাল রবীন্দ্রনাথের-গানের উদ্দাম মত্ততায় অথবা কচি-কণ্ঠের ধমক দিয়ে শেখানো আবৃত্তিতে।

তারপর সারাদিন ধরে তারই রেশ ধরে চলতে থাকে পাড়ার মোড়ে মোড়ে নানান অনুষ্ঠান- বসে আঁকো আর গান ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বর্ণাঢ্য ধূম। সুসজ্জিত পোশাকে জনসমাগমে পরিবৃত হয়ে রাত অবধি চলতে থাকে এই মেহফিল। আর তারপর ২৬শে বৈশাখে আবার মূর্তি আর ছবিগুলোর গলায় হাওয়ায় দুলতে থাকে বিগত দিবসের রজনীর কঙ্কাল।

body1_050818032938.jpgএকটু রাবীন্দ্রিক হতে পারলে আমরা বর্তে যাই

এমনটাই কি হবার কথা ছিল? সত্যিই সত্যিই অন্তত বাঙালিদের তো জাতীয় উৎসবের দিন হওয়ার কথা ছিল এই দিনটার। নাকি রবীন্দ্রনাথ শুধুই পরীক্ষা-পাসের সিলেবাসের প্রশ্নে আর উত্তরের খাতায়? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সিন্থেসাইজার আর ইলেক্ট্রিক গিটারে পুরানো সেই দিনের কথা বাজাতে পারার এলিটিস্ট দম্ভে? রবি ঠাকুর বাঙালিদের কাছে খুব সহজে পেয়ে যাওয়া কেমন যেন হাতের নাগালে থাকা অথচ কাচের জারে পোরা একটা আশ্চর্য বস্তু হয়ে গেলেন। সদম্ভে তাঁকে জাহিরও করা যায়, আবার নিত্য দিনকার প্রয়োজনে বুঝে বা না বুঝে ব্যবহারও করা যেতে পারে। আমরা কি তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী? কী জানি কেমন যেন সন্দেহ হয়।

সেই আকাশ আর আশি বছরের যন্ত্রণার যথার্থ ভাগীদার কি সত্যি সত্যিই হতে পেরেছি আমরা? সারাদিন ধরে আমাদের চারপাশে যা ঘটে এবং ঘটে চলেছে, আমাদের অধিকাংশের প্রতিদিনকার জীবন যাপনে বা চর্যায় কোথাও কি আজ রবীন্দ্রনাথের কোনো ছোঁয়া আছে? দিনান্তে নিয়ত একলা হয়ে যাওয়া আমাদের কাছে কি কখনো এসে দাঁড়ান অন্য কোনও রবি ঠাকুর? একটু রাবীন্দ্রিক হতে পারলে আমরা বর্তে যাই। হওয়ার চেষ্টারও ত্রুটি নেই আমাদের, জীবন শুকিয়ে যাচ্ছে করুণাধারায় কে আর আসবে এখন!

body2_050818033134.jpgরবীন্দ্রনাথ কী শুধুই পরীক্ষা-পাসের সিলেবাসের প্রশ্নে আর উত্তরের খাতায়?

আমরা কৃপণ, দীনহীন মন নিয়ে পড়ে আছি, দুয়ার খুলে রাজ সমারোহে যাঁকে রুদ্র আলোকে বরণ করে নেওয়ার কথা ছিল তাঁকে সত্যি সত্যিই বরণ করতে পারলাম আর কই? অনেক, অনেকদিন আমি যে কোনও দাদাঠাকুর, রঞ্জন, অভিজিৎ কিম্বা অন্তুকে দেখতে পাচ্ছি না আর। কোথায় গেল দামিনী, নন্দিনী কিম্বা এলারা? জানলার ধারে বসে থাকা কোনো অমলকেও তো দেখতে পাই না আর রচনাবলির পাতায় ছাড়া...। মহাপঞ্চকদের তর্জনে, পঞ্চকরা কি থ’ মেরে গেল একেবারে?

একটু কি বেশি সিনিক হয়ে গেলাম, হয়তো! হঠাৎ মনে হল এখনো তো ফেসবুকের পাতায় প্রতিদিন কোনও বন্ধু নিত্যনতুন ছবির সঙ্গে পোস্ট করেন রবীন্দ্রনাথেরই কোনও না কোনও রচনার উদ্ধৃতি। এখনও তো সোস্যাল সাইটগুলোয় ঢুকলেই দেখতে পাই কোনও চেনা অথবা অচেনা রবীন্দ্র-প্রেমিক ঠিক পুরোনো অথবা নতুন কোনো শিল্পীর গাওয়া রবি ঠাকুরের অসাধারণ কোনও গান পোস্ট করে রেখেছেন অন্যরা শুনবে এই ভরসায়। কে জানে ঠিক এই মুহূর্তেই হয়ত কোথাও কোনও খানে রবীন্দ্রনাথের লেখায় মুখ গুঁজে তন্ময় হয়ে বসে আছে কোনও একলা পাঠক। কিম্বা হয়তো কোনো বাড়িতে এখনও বয়োঃজ্যেষ্ঠর কাছে রবি ঠাকুরের কোনো কবিতা শুনে আধো গলায় তার পুনরাবৃত্তি করছে কোনও কচি ছেলে বা মেয়ে। মুগ্ধ চোখে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি খুলে বসে আছে কোনো অজানা তরুণ শিল্পী। কারো পরোয়া না করে আঁধার রাতে কোন একলা পাগল, ভিড় নাট্যাঙ্গনের অন্ধকারে এপার থেকে ওপারে পায়চারি করতে করতে গেয়ে চলেছে রবি ঠাকুরেরই গান। কে জানে হয়ত আমাদের অজান্তেই এখন রবীন্দ্রনাটক মঞ্চস্থ করার উৎসাহ নিয়ে টগবগ করে ফুটছে কোনও উদীয়মান যুবক কিম্বা কোনও চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্ন মৃণাল প্রিয়তমকে লিখছে তার শেষ চিঠি, নতুন করে বেঁচে উঠবার ভরসায়।

body3_050818033301.jpgবয়োঃজ্যেষ্ঠর কাছে রবি ঠাকুরের কোনো কবিতা শুনে আধো গলায় তার পুনরাবৃত্তি করছে কোনও কচি ছেলে বা মেয়ে

আসলে উনি থাকবেন, এভাবেই থাকবেন- হয়তো আমরা যে ভাবে চাই সেভাবে নয়, কিন্তু আমাদের বাঙালিদের যে ওঁকে এড়ানোর জো নেই। প্রতিনিয়ত টুকরো হয়ে যাওয়া এই সময়কে যুঝে নেওয়ার রসদ তো আসলে লুকিয়ে আছে তাঁর মধ্যেই। তাই ঠিক যখন মনে হয় হারিয়ে ফেলছি তাঁকে, একরাশ রক্তকরবীর উজ্জ্বলতা নিয়ে মনের ভেতরে শান্ত পায়ের স্পর্শ নিয়ে কোথায় যেন বসে থাকেন আমার, আমাদের সবার রবীন্দ্রনাথ!

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SARASIJ SENGUPTA SARASIJ SENGUPTA

Associate Professor Department of Bengali St. paul's C.M. College

Comment