পটৌদীর নবাবের কথা অনুরাগীদের জানা উচিৎ, বলছেন সোহা আলি খান (বই থেকে উদ্ধৃত)
আঘাত লাগার আগে আব্বা যে ঠিক কতটা ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন সেটা পরে জানতে পারি
- Total Shares
সবসময়ই আমার মনে হয়েছে যে আব্বার কথা লোকের জানা উচিৎ। আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন তখন অনেক বার আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছি যে উনি কি ওঁর আত্মজীবনী লিখতে চান না? উত্তরে খুব রহস্যজনক ভাবে উনি বলতেন, "সত্যিটা কখনও বলতে পারব না, আর আমি মিথ্যে কথা বলব না।" উনি যে কী বলতে চাইছেন, সে কথা বোঝার আশা আমি খুব শীঘ্রই ত্যাগ করতাম—উনি সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসতেন—আমার ধারনা লোককে থামিয়ে দেওয়ার জন্যই উনি এটা করতেন, তবে কেউ নাছোড় হলে উনি কথা চালিয়ে যেতেন।
আমি যদিও এই বিষয়ে আব্বাকে কোনও দিন জোর করিনি। তবে তাঁর প্রয়াণের পরে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে লেখা, স্মৃতিচারণা, মাকে লেখা বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও ভক্তদের চিঠিপত্র পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি। আমি একই সঙ্গে অবাক হয়েছি আবার খুব গর্বিও হয়েছি। কত মানুষ আব্বাকে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। একজন মানুষ যাঁকে সবাই এত ভালোবাসতেন, সেই মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসতেন সে কথা ভেবেই সেদিন খুব গর্বিত হয়েছিলাম।
আব্বার শব্দভাণ্ডার বিপুল হলেও তিনি মিতভাষী ছিলেন
আব্বা বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন। বাড়িই ছিল তাঁর সব চেয়ে প্রিয় জায়গা। আব্বাকে নিয়ে একটা স্মৃতি আমার ভীষণ মনে পড়ে। আব্বা যখন বাড়িতে থাকতেন তখন তিনি তাঁর ঘরের জানালার সামনে একটা তাকিয়াতে ঠেস দিয়ে বই পড়তেন। তার ঘরের জানালা দিয়ে আশপাশের গাছপালা ও নানা পাখি দেখা যেত। বই পড়ার সময় আব্বার সব চেয়ে বিশ্বস্ত পুরুষ ভৃত্য-গিয়াসুদ্দিন তাঁর পা টিপে দিতেন।
কাজের সূত্রে আমার মা, দাদা, বোন ও আমাকে দেশে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত। কখনও হয়ত সিনেমার জন্য আবার কখনও হয়ত বক্তৃতা করার জন্য কিংবা কোন সময় পুরষ্কার দেওয়া বা গ্রহণ করার জন্য। আমরা সবাই খুব ব্যস্ত থাকতাম। তবুও আমরা একটা ব্যাপারে খুব নিশ্চিন্ত থাকতাম যে বাড়িতে একজন রয়েছেন যিনি সর্বক্ষণ ফোনের পাশে বসে রয়েছেন আমাদের ফোনের অপেক্ষায়। এমন একজন বলিষ্ঠ মানুষ যাঁর উপরে আমরা সবাই নির্ভর করতে পারি। আব্বার সঙ্গে ফোনের একটা অদ্ভুত ভালোবাসা অথচ একটা ঘৃণার সম্পর্ক ছিল। ফোন বেজে ওঠার শব্দটা উনি এক্কেবারে পছন্দ করতেন না কিন্তু তবুও আমাদের ফোন আসবে বলে প্রায় সর্বক্ষণ ওই ফোনটার পাশেই বসে থাকতেন।
ছবি: মেল টুডে
যখন তার কোনও বন্ধু বাড়িতে টেলিফোন করে একটি ষোলো বছরের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, তখন একটা রাশভারী গলায় 'না' ভেসে আসার পরে ফোনটা কেটে দেওয়া হলে যে কতটা খারাপ লাগতো, সেটা বোঝানো খুব একটা কঠিন নয়। আমাদের বাড়িতে একটাই ল্যান্ডলাইন ছিল, এবং সেই ল্যান্ডলাইনটার উপর শুধু আব্বারই অধিকার ছিল। তাতে একটা বিশাল লম্বা তার যোগ করা থাকত যাতে বিছানায় শুয়েও আব্বা ফোনে কথা বলতে পারেন। আর রাতে শোওয়ার সময় উনি টেলিফোনের নম্বরের জায়গায় তালা লাগিয়ে দিতেন।
আব্বার শব্দভাণ্ডার বিপুল হলেও তিনি মিতভাষী ছিলেন, এমনকি আমাদের সঙ্গেও কম কথা বলতেন। আব্বাকে কখনও তাঁর জীবনের কোনও খারাপ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে শুনিনি। আব্বার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে আব্বা বলতেন যে বাবাকে তাঁর তেমন একটা মনে নেই। আর কখনও যদি আমি আব্বাকে তাঁর চোখে কি হয়েছিল সেটা জিজ্ঞেস করতাম তা হলে তিনি শুধু বলতেন যে "এটা কিছুটা দুর্ভাগ্য।"
ছবি: মেল টুডে
খেলতে গিয়ে আব্বার একবার চোখে মারাত্মক আঘাত লাগে। আঘাত লাগার আগে আব্বা যে ঠিক কতটা ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন সেটা পরে বন্ধুবান্ধব ও আব্বাকে নিয়ে লেখা নানা প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি। দুরন্ত গতির জন্য স্কুলজীবন থেকেই তিনি ভালো ব্যাটসম্যান হিসাবে বেশ নাম করে ফেলেছিলেন। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ঝোঁক দেখে তাঁকে ক্রিকেটে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বড়ি আম্মান নিয়োগ করেছিলেন পেশাদার ইংরেজ ক্রিকেটার এবং সরকার আব্বার কোচ ফ্রাঙ্ক উলিকে। সেই সময় আমার আব্বার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
ফ্রাঙ্ক উলি যখন আব্বাকে ক্রিকেট শিখাতেন তখন বড়ি আম্মান দূরে বসে সেই খেলা দেখতেন। তিনি আব্বার সবকটি ক্লাস দূর থেকে বসে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করতেন। খুব তাড়াতাড়ি তিনি লক্ষ করলেন যে, প্রশিক্ষণের বেশিরভাগ সময়টাই উলি মাঠের এক ধারে দাঁড়িয়ে আব্বার নেট প্র্যাকটিস দেখে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকবার এটা লক্ষ্য করার পর একদিন বড়ি আম্মান উলিকে সবিনয়ে বললেন যে ক্রিকেট শেখানোর জন্য তাঁকে মোটা অঙ্কের বেতন দেওয়া হচ্ছে। উলি বড়ি আম্মানের দিকে তাকিয়ে সারল্যের সঙ্গে বললেন, "আমি কোনও কিছুই বদলাব না। আমি আদৌ কিছু বদলাব না।"(সৌজন্য: মেল টুডে)

